অমর্ত্য সেনের মতো সর্বার্থে জ্ঞানী ও গুণীজনের ব্যাপারে আমার মতো একজন অজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষের কিছু বলার অধিকার আদৌ আছে কিনা এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। তা সত্ত্বেও, যখন আমার চাইতেও গণ্ডমূর্খেরা তাঁকে অশালীন ভাষায় অপমান করার চেষ্টা করেন তখন আর চুপ করে থাকা যায় না। “চেষ্টা” বলছি এইজন্যে যে, অমর্ত্য সেন বৈদগ্ধের যে শিখরে পৌঁছেছেন সেখানে এসব অপমান তাঁকে স্পর্শ করেনা। এর আগেও এ ধরণের আক্রমণ হয়েছিল সত্যজিত রায়ের ওপর। অবান্তর কথা বলা হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সত্যেন বসুর গবেষণা সম্বন্ধেও। উভয় ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্র এবং বিজ্ঞানের জগতের দিকপালেরা সেইসব স্বল্প-শিক্ষিত সমালোচকদের উপযুক্ত জবাব দিয়েছিলেন। আজ সত্যজিত সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রকারদের অন্যতম রূপে সম্মানিত আর সত্যেন বসু বিজ্ঞানের জগতে অমরত্ব লাভ করেছেন। সমালোচকদের কেই বা মনে রেখেছে!
অধ্যাপক সেন যখন অর্থনীতির মতো বিষয়ে লেখেন বা বলেন তখন তার সবটাই বুঝতে পারি এমন দাবী করার স্পর্ধা আমার মতো অর্ধ-শিক্ষিতের নেই। কিন্তু তিনি তো শুধু অর্থনীতিবিদ নন। শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য-ইতিহাসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিস্ময়কর পদচারণ। আজ অধ্যাপক সেনকে কারণে অকারণে বিদ্ধ করছেন যে মহারথীরা তাঁদের ভাষা থেকেই স্পষ্ট যে অমর্ত্য সেনের বিচরণ-ক্ষেত্র তাঁদের গোচারণের মাঠ নয়। আপ্ত বাক্য বলে, “তাবচ্চ শোভতে মূর্খং …” ইত্যাদি। কিন্তু এঁরা যে জগতের মানুষ তাতে নেতা-কথিত সুসমাচার ভিন্ন অন্য শাস্ত্রে তাঁদের অধিকার বা বিশ্বাস কোনটাই প্রশ্নাতীত নয়। তা না হলে, এই প্রশ্ন উঠতনা যে অমর্ত্য সেনের নোবেল ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের সবুজায়নে কোন জলটা ঢেলেছে! তাঁর চিন্তার ফসল আমাদের সমৃদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়াও তাঁর প্রত্যক্ষ অবদানও কিছু কম নয়। কিন্তু যদি তা নাও হত, তাহলেও কি আমরা অমর্ত্য সেনের জন্য গর্ব বোধ করতাম না? এ তো সেই পুরনো কথা, “শিবলিঙ্গ দিয়ে যদি পেরেক ঠোকা না যায় তাহলে কোন গুণ নাই তার, কপালে আগুণ”।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই মূর্খদের সমালোচনায় এত বাক্যব্যয় করছি কেন। আমার ধারণা, প্রয়োজন আছে। অমর্ত্য সেন নিজে তাঁর সমালোচনার জবাব দেননি। বলেছেন, প্রত্যেকেরই আপন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। নিশ্চয় আছে। তবে কিনা আজ যেভাবে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে এই স্বাধীনতা বিভিন্নভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে যদি আমরা অন্ততঃ ক্ষীণ প্রতিবাদটুকুও না জানাই তাহলে ভবিষ্যতে তা আমাদের লজ্জার কারণ হতে পারে। আজ এই ইন্টারনেটের যুগে, সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথ্যার ব্যাপারীদের সমর্থকবৃন্দ যে ভাবে শৃগাল-ধ্বনিতে দশ দিক মুখরিত করে তুলছে, এবং যখন জনসাধারণের একটা বিশাল অংশ “নেটে” প্রকাশিত সমস্তরকম “তথ্য”কে ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন তাতে এ ভয় হয় যে একদিন না ভারত সরকারের শিলমোহরের নীচের বাক্যটি পাল্টে গিয়ে “মিথ্যৈব জয়তে” হয়ে যায়।
তাঁর বিখ্যাত “তর্ক প্রিয় ভারতীয়” বইয়ে অধ্যাপক সেন নিজেই বড় সুন্দর এবং প্রাঞ্জল ভাবে দেখিয়েছেন যে তর্ক-বিতর্ক ভারতীয় জীবনের অঙ্গ। প্রশ্ন করার এবং ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার ভারতবর্ষে কখনো কেড়ে নেওয়া হয়নি। এটাই আমাদের উত্তরাধিকার, এই আমাদের গর্ব। ইদানিং সেই ঐতিহ্য থেকে আমরা সরে আসছি। অমর্ত্য সেনের মতো মানুষদের প্রতি অশালীন আক্রমণ তারই অশনি সংকেত।
*****