ভাষা নিয়ে, বিশেষ করে বাংলা ভাষা নিয়ে, কিছু বলতে আমি বেশ ভয় পাই। একে তো আমার লেখনী দুর্বল, তার ওপরে ভাষা বাবদে আমি কোনরকম জোরজার বা উন্নাসিকতার একান্ত বিরোধী। আমার এই অবস্থানকে অনেকেই মাতৃভাষার প্রতি আমার ভালবাসার অভাব বলে মনে করেন।

সদ্য সদ্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হল; এখন ‘ভাষা জাতীয়তাবাদ’ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এইতো সেদিন এক প্রধান শিক্ষিকা আমাকে রীতিমতো ধমকে দিলেন। আমার দোষ ছিল এই যে আমি বলেছিলাম কোন আলোচনায়, যেখানে অন্য ভাষাভাষী বন্ধুরাও রয়েছেন, সেখানে এমন একটা ভাষা ব্যবহার করা উচিত যেটা সকলে বোঝেন। জবাবে শুনতে হল – অবাঙালীরা বাঙলায় বাস করে যদি আমার ভাষাকে অবজ্ঞা এবং অশ্রদ্ধা করতে পারেন, তাহলে আমি কেন আমার ভাষায় কথা বলব না / বা লিখবো না? কোন ভাষা ভালভাবে বলতে, বুঝতে, লিখতে বা পড়তে না পারলেই তাকে অশ্রদ্ধা করা হয়, এটা ভাবা কি ঠিক? কিন্তু আমরা মাতৃভাষা প্রেমে এতই বিভোর যে যুক্তির ধার ধারিনা। এই অন্ধ আবেগই কিন্তু বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।

যে কোন সজীব ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়। অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে, সেই শব্দগুলিকে আত্মস্থ করে ভাষা সমৃদ্ধ হয় এবং উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এর ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং বলতে পারি পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ণময় এবং সমৃদ্ধ ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা অন্যতম হয়ে উঠেছে তার এই শব্দ গ্রহণ এবং আত্মিকরণের জন্য। এটা আমাদের বিশেষ গর্বের বিষয়।

বাংলাভাষার এই বিবর্তনের পথে পশ্চিমবাংলা এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহুল ব্যবহৃত কথ্য ভাষা এবং শব্দ বাংলার মূল ধারাকে পুষ্ট করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। আজকের বাংলা সাহিত্যের ভাষা, বাংলা সাংবাদিকতার ভাষা, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনের ভাষায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। বদলে গেছে শব্দচয়ন এবং তার প্রয়োগ। তথাকথিত “ভদ্রলোকের” ভাষা থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের সাহিত্যের বাংলা এবং প্রায়োগিক বাংলা সাধারণ বাঙালির ভাষা হয়ে উঠেছে, এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন সত্ত্বেও প্রত্যেক ভাষার একটা সর্বজন-গ্রাহ্য রূপ থাকে, যাকে অস্বীকার করলে, যাকে পালটে দিলে ভাষার নান্দনিক দিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার মাধুর্য নষ্ট হয়। সাদা বাংলায় যাকে আমরা বলি, ‘ভাষাটা কানে লাগছে’। এই কানে লাগাটা ধীরে ধীরে আমাদের অভ্যাস হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু এই জাতীয় পরিবর্তন আমার মতো অত্যন্ত সাধারণ বাংলা-প্রেমীর কাছে বড়ই কষ্টকর এবং অবাঞ্ছনীয় মনে হয়। একটা উদাহরণ দিয়ে আমার বক্তব্যটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি।

বহু বছর আগে গোল দীঘির ধারে একটি পুরনো বইয়ের দোকানে গেছি বই কিনতে। আমাদের প্রয়োজনীয় বইটি দোকানীর সংগ্রহে ছিলনা। আমি পাশের দোকানের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, “ওঁকে জিগ্যেস করুন না, যদি ওঁর কাছে থাকে?”। দোকানী ভদ্রলোক একটু রাগের সঙ্গেই বললেন, “ওকে বলছেন কেন, বলুন ‘ওনাকে’! আমি আর কথা বাড়াই নি।

ধীরে ধীরে আমরা ‘ওনাকে, ওনাদের এবং ওনারায়’ অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল – যদি ‘ওনারা’ লিখি, তাহলে ‘ওনাদের বা তেনাদের’ লিখিনা কেন?

কলকাতায় গেলে বাসে ট্রামেই যাতায়াত করি। আজকাল, অফিস কাছারিতে কাজ করেন, দেখে শিক্ষিতও মনে হয় এমন মানুষেরাও প্রায়ই বলেন শুনি, ‘ভদ্রলোক কি বলল দাদা?’ এই যদি আমাদের ভাষা হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে, স্কুল কলেজের মাস্টারমশাইরাও কি এই ধরণের ভাষায় কথা বলে(ন) বা ছাত্রদের শেখায় (ন)?

রবীন্দ্রনাথ একজায়গায় লিখেছিলেন, ‘সে কথা বানিয়ে তোলার ভার তোমার ওপর নেই’ । ‘বানানো’ শব্দটার অর্থ পরিষ্কার বোঝা যায় এই বাক্যটি থেকে। কিন্তু ‘হালে’ আমরা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বানাই, ছবি বানাই, প্রতিমা বানাই এমন কি রান্নাও আর ‘করি’ না, বানাই। অথচ রাস্তাঘাট তৈরি করতেও পারি, ছবি আঁকতে পারি প্রতিমা গড়তে এবং রান্না করতে পারি। বানানো এবং তৈরি করা কাছাকাছি হলেও সবসময় সমার্থক নয়, এই কথাটাই আমরা ভুলতে বসেছি। মাঝে মাঝে ভাবি তাহলে কি এই ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, খাবারদাবার এগুলো সত্যি নয় – এদের অস্তিত্ব আসলে নেই? বাংলা ভাষা কি এত দুর্বল হয়ে গেছে যে সবই আমরা ‘বানাবো’, তৈরি হবেনা কিছুই?