দিল্লি ফেরার কথা ছিল ২৬শে মার্চ। এর মধ্যে রাজ্যসরকার কলকাতা ও আরও কয়েক জায়গায় লকডাউন ঘোষণা করে দিল ২৭শে মার্চ পর্যন্ত, অথচ বলা হল এয়ারপোর্ট খোলা থাকবে।। সবরকম গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, কিন্তু এয়ারপোর্ট, রেলষ্টেশন ইত্যাদি থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে। সে নয় যারা বাইরে থেকে এখানে আসবে তাদের আটকা পড়তে হবে না। কিন্তু আমরা বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট যাবো কি করে? সে ধাঁধাঁর কোন উত্তর নেই। এদিকে এয়ার ইন্ডিয়া যথারীতি বলে চলেছে তাদের ফ্লাইট চালু থাকবে।
দিল্লির অবস্থা ভাল নয়, বাড়ির সবাই বলছিল যাওয়া বাতিল করতে। সকাল বিকেল হাঁটতে বেরোলেই প্রতিবেশীদের প্রশ্ন, “আপনারা কি যাচ্ছেন?”। আমরা ভেবেছিলাম ফ্লাইট যদি চালু থাকে, তো যাব। দিল্লিতে কিছু জরুরী কাজ ছিল।
২২শে মার্চ থালা বাজানো হল দেশজুড়ে । হাততালি দেওয়া, ঘন্টা বাজানো পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু থালা বাজানোটা লক্ষ্মীছাড়া দশা বলেই জানতাম। যাহোক, ২৩ তারিখের ঘোষণায় রাজ্যসরকার লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিল ৩১শে মার্চ পর্যন্ত, এবং ২৪ তারিখ বিকেল চারটে পর্যন্ত কয়েক ঘন্টার ছাড় দেওয়া হল। আবার সেই দিনই প্রধানমন্ত্রীর সন্ধ্যে আটটায় ভাষণ দেওয়ার কথা।
সেই নোটবাতিলের সময় থেকে উনি কিছু বলবেন শুনলেই আমার হৃদকম্প হয়। সেবার আমাকে পরপর চার দিন বিভিন্ন ব্যাংকে সকাল থেকে লাইন দিতে হয়েছিল সামান্য কয়েকটা টাকা জমা করার জন্যে। প্রবীণ নাগরিকদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থাটা ছিল একটা বিশেষ ধাপ্পা । আর প্রত্যেক সপ্তাহে নতুন নতুন নিয়মকানুনের ঘোষণা হচ্ছিল। তাই এবার বড় ভয়ে ছিলাম, আবার কি নতুন যন্তন্না কপালে আছে কে জানে !
২৪শে মার্চ রাত বারোটা থেকে দেশব্যাপী একুশ দিনের লকডাউন হবে জেনেই বুঝতে পারলাম আমাদের যাওয়া হবে না। কিন্তু যদি থাকতেই হয়, আবার নতুন করে রসদ সংগ্রহ করতে হবে, কারণ ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। তখনও এয়ার ইন্ডিয়া কিছুতেই বলছেনা তারা উড়ান বাতিল করবে কি না। মানুষকে এরকম বিপদে ফেলতে পারে একমাত্র আমাদের দেশের সংস্থা গুলো । ভরসার কথা এই যে ২৪শে বিকেল চারটে পর্যন্ত হাতে সময় আছে ।
এয়ার ইন্ডিয়ার ওয়েব সাইটে টিকিট কাটা যায়, বাতিল করা যায়, কিন্তু টিকিটের তারিখ বদলানো যায় না। তার জন্যে কাস্টমার কেয়ারএ ফোন করার গব্বযন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। এবং সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই আপনাকে এ পৃথিবীর মায়া কাটাতে হতে পারে।
একঘন্টা চেষ্টা করে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি, তখনই মনে পড়ল আমার প্রতিবেশীর কোন এক আত্মীয় এয়ার ইন্ডিয়ায় কাজ করেন। অবশেষে ব্যবস্থা হল । ওদের এয়ারপোর্ট অফিসে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফ্লাইটের তারিখ বদলানোর কাজটা করা গেল। এয়ারপোর্টের কাছে বাড়ি হওয়ার এই সুবিধে।
ব্যস। সেই থেকে বন্দীদশা চলেছে। অবশ্য একেবারে সলিটারি কনফাইনমেন্ট নয়। এখনও পর্যন্ত আমাদের আবাসনের চৌহদ্দির মধ্যে ছাড়াছাড়া হয়ে হাঁটাচলায় বাধা নেই। এবং একটা পুরো পাক দিলে পাক্কা এক কিলোমিটার হাঁটা হয়ে যায়। তাই সকাল সকাল পাঁচ ছয় চক্কর যথেষ্ট।
প্রথম দিকে একটু ভয় হয়েছিল। যদি খাবারদাবার ওষুধপত্র অমিল হয় তাহলে কি হবে। তবে এখন দেখছি মোটামুটি সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে । যে ছেলেটি আমাদের ওষুধ দেয়, সে যথারীতি সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছে। মুখোশ পড়ে দুধ আনতে বা গেটের কাছ থেকে সব্জি কিনতে যাওয়ায় বাধা নেই। অবশ্য রোজ তাজা সব্জি আর “জ্যান্ত মাছ” কিনতে বাজার যাওয়ার বিলাসিতা বা বদ অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছি কবেই ।

টরন্টো থেকে ছেলে জানাল সেখানে পার্কে যেতে কোনও বাধা নেই, কিন্তু মাস্ক পরে, আর দূরে দূরে বসতে হবে। ওরা মাঝে মাঝে সেই ভাবেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করছে। এখানে তো সে সুখও নেই। অবশ্য আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পাড়ার যতীনবাবুর পর্যন্ত যা স্বভাব ! একটু ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে দেখা হলেই একেবারে ভালুক আলিঙ্গন! আমাদের জন্যে তাই লকডাউন কেন, লকআপই বোধহয় ভাল ।
হোয়াটসঅ্যাপে একটা পোষ্ট বা পোষ্টার পেয়েছিলাম, সবাই দেখেছে মনে হয় – “ইতিহাস বলবে, বাঙালি বলে একটা জাতি ছিল যারা শুধু বাজার করতে করতে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল”। অত সহজে আমরা বিলুপ্ত হব কি না জানিনা । তবে কয়েকদিন আগে আমাকে মিনিট দশেকের হাঁটা রাস্তায় একটা বাজারে যেতে হয়েছিল। বাজারটা বড়ই, এবং কলকাতার পুরনো বাজারগুলোর ধাঁচে তৈরি। সেখানে গিয়ে বুঝলাম নীরদ চৌধুরীর বইটা সার্থকনামা।
একটা জাত যে আত্মহত্যা করার জন্যে এমন ক্ষেপে উঠতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হত না। গিজগিজ করছে লোক । কারো মুখে মাস্ক, কারো রুমাল বা গামছা । মাংসের দোকানে লম্বা লাইন। সামাজিক দূরত্বকে গুলি মেরে রীতিমতো গলাগলি করে কেনাকাটা চলছে । নিত্য প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় সব দোকানই খোলা।
বাজার করার ধূম দেখে মনে হচ্ছে সব বাড়িতে উৎসব! কে বলবে দেশে একটা মহামারী দেখা দিয়েছে, এবং কলকাতা ও তার আশপাশের জেলাগুলো অতি স্পর্শকাতর ! মনে হল কবি সত্যেন দত্তের “মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি”… সব বাঙালি আপ্তবাক্য বলে ধরে নিয়ে দার্শনিক হয়ে গেছে।
তবে লকডাউনে্র ফলে এক ধরণের মানুষ বড় কষ্টে আছে। পাড়ার রকে বা চায়ের দোকানে সকাল বিকেল দুদণ্ড না বসতে পারলে যাদের ক্ষিদে হয়না, সেই তারা। লকডাউনের প্রথম ভাগে যদিও লুকিয়ে চুরিয়ে দু একটা চায়ের দোকান খুলছিল, সব লাল হয়ে যাওয়ার ফলে সে সব বন্ধ, আর একসঙ্গে জটলা করতে দেখলেই পুলিশ রে রে করে তেড়ে আসছে । মুখে মাস্ক থাকলেও রক্ষা নেই ।
বাজার যাচ্ছিনা, আড্ডা মারার অভ্যেস নেই, তাহলে সময় কাটছে কি করে, এটা, যাকে বলে একটা ভ্যালিড প্রশ্ন। আমার উত্তর – প্রধানতঃ বই পড়ে । যে সামান্য কয়েকটা বই আমার আছে, সেগুলো না থাকলে সময় কাটানো নিশ্চয় শক্ত হত। কিন্তু অবসরের সাথী আমার বইগুলো দিল্লি আর কলকাতার মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। ফলে আমার পড়ার বিষয় নির্ভর করে আমি কোথায় আছি তার ওপরে।

ন্যাশনাল ডিজিটাল লাইব্রেরীর দৌলতে এখন এত বিভিন্ন বিষয়ের দুষ্প্রাপ্য বই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে যে পড়ার ইচ্ছে থাকলে রেস্ত নাস্তির মিথ্যে অজুহাত আর দেওয়া যাচ্ছেনা। এ ছাড়া, নতুন নতুন বই পড়তে হলে – এই লকডাউনের মধ্যেও – সাধ্যের মধ্যেই রয়েছে ই-বুক । কাজেই, সময় আর বই পড়ার যুগল-বন্দীর এই হচ্ছে আদর্শ অবসর।
সেদিন এক বন্ধু ফোন করে জিজ্ঞাসা করল কেমন আছি। ভেবে দেখলে , খুব খারাপ যে আছি তা বলতে পারিনা। ঘরের কাজ একটু বেশী করতে হচ্ছে। আর সবই তো একইরকম । টিভি দেখছি, খবরের কাগজ পড়ছি । ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা দুনিয়ার সব “জ্ঞান” আমার টেবিলে।
হোটেল রেষ্টুরেন্ট আর সিনেমা হলগুলো বন্ধ থাকায় কিছু খরচ বাঁচছে । আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বন্ধ । কিন্তু ফোন তো আজকাল সকলেরই মুঠোয়। দু’দিন অন্তর একই অবান্তর কথার আদানপ্রদান অব্যাহত। হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার্, ফেসবুক আর ইন্সট্যাগ্র্যাম আমদের সারাদিন বেশ ব্যস্ত রেখেছে । গাড়ির শব্দ নেই, হাওয়ায় ধোঁয়া নেই । সারা দুপুর কত পাখীর ডাক।
গেটের বাইরে যে লোকটি সব্জী বিক্রী করছে ইদানিং, তার হিসেব করা দেখেই বুঝলাম এটা তার পেশা নয়। শুনলাম আগে টোটো চালাত। এখন এই করছে। আমরা তাকে দিব্যি তুইতোকারি করছি, আর দরদাম করে দু’টাকা বাঁচাতে পারলে হাতে স্বর্গ পাচ্ছি।
আমাদের ঘরের কাজে সাহায্য করতো যে মেয়েটি, তার আসা বন্ধ। ওর স্বামীও বেকার। জিজ্ঞাসা করছিল কবে থেকে আবার কাজে আসতে পারবে। এর উত্তর আমাদেরও জানা নেই। যদিও আমরা ওর মাইনে বন্ধ করিনি, ওর ভয় যদি কাজ না থাকে, চলবে কি করে।
লকডাউনের আজ চল্লিশ দিন হল। আমরা ভালই আছি !