কলকাতায় আমাদের পাড়া আমহার্স্ট স্ট্রীটের বিখ্যাত কালীপুজোর কথা কে না জানে ! এখন দু-চার দিনের মধ্যে ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যায়। আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু প্রায় সাতদিন ধরে চলতো আলোর বাহার, ফুটপাথের মেলা আর মানুষের ঠাকুর দেখার ভীড়। ভেবে দেখলে হয়তো ব্যাপারটা ঠিক নয়। শহরের একটা প্রধান রাস্তা অতদিন ধরে বন্ধ রাখা। তখন অত ভাবতাম না অবশ্য।
একটা ব্যাপারে কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় কালীপুজো ছিল অন্যরকম। যে সাতদিন ঠাকুর থাকতো প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোত পাশেই সেন্টপলস স্কুলের মাঠে। কোন সন্ধ্যেয় যাত্রা, কোনদিন আধুনিক গান, নাটক, ম্যাজিক শো আরও কত কি।
আমাদের পুজো প্যান্ডালের পাশেই একটা বেশ বড়ো স্টেজ তৈরি হতো। আজও হয়। তবে তখন ফুটপাথটা অনেক চওড়া ছিল । ফলে স্টেজের মাপটা হতো আজকের চেয়ে বড়। স্টেজের সামনে ফুটপাথে পাতা হতো কয়েকশ চেয়ার। প্ল্যাস্টিকের নয়, সেই সেকেলে কাঠের নড়বড়ে “ফোল্ডিং” চেয়ার। এই মঞ্চটাতেও কিন্তু অনেক গান-বাজনার আসর বসতো, এবং তখনকার অনেক জনপ্রিয় শিল্পী আসর মাতাতেন।
আর আসতেন একটু বেশী রাতে বড়ো বড়ো অভিনেতা অভিনেত্রীরা – বাংলা ও হিন্দি সিনেমার অনেক সুপারস্টার। সেইসব তারকা-খচিত রাত কখনও কখনও আমাদের কোন কোন অত্যুৎসাহী বন্ধুর মানসিক এবং শারীরিক বেদনারও কারণ হয়েছে। কিন্তু সে গল্প বন্ধুদের অনুমতি সাপেক্ষে আগামী কোন দিনের জন্য তোলা থাক।
এইরকমই এক সন্ধ্যেয় ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের অনুষ্ঠান। আমরা কয়েক জন একেবারে প্রায় প্রথম সারি দখল করে বসে আছি অনেক আগে থেকে। সব চেয়ার তো ভরে গেছেই ; রাস্তা এবং উল্টো দিকের ফুটপাথ, আনাচ কানাচ সব ভীড়ে ঠাসা। কিন্ত তিনি কই? আমি এর আগে সামনাসামনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দেখিনি । মাইকে একজন বলছে বটে “হেমন্তদা এখনই এসে পড়বেন”, কিন্তু কোথায় তিনি!
চেয়ার ছেড়ে আমরা কয়েকজন স্টেজের ওপর উঠলাম একটু ভালো করে দেখার জন্যে, কোনদিক থেকে উনি আসছেন। দেখি, হ্যারিসনরোডের দিক থেকে ভীড় ঠেলে ধুতি আর হাতা-গোটানো লম্বা শার্ট পরা এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। কালো মোটা ফ্রেমের চশমায় বেশ রাশভারী চেহারা। এবার পাড়ার দাদাদের দৌড়ো-দৌড়ি থেকে বুঝলাম এতক্ষণ আমরা ওঁরই প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমাদের তো তাড়ামেরে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিল। বসলাম এসে নীচে, চেয়ারে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্টেজে উঠলেন। মনে পড়ে, উনি সেদিন চেয়ারে বসে গান করেছিলেন। সামনের টেবিলে ছিল হারমোনিয়ম আর এক গ্লাস জল। তবলায় যিনি সঙ্গত করছিলেন তিনি বসেছিলেন স্টেজের “ফ্লোরে”। আর কোন বাজনা ছিলনা। সামনে সেই সেকেলে মাইক্রোফোন, দু’দিকে দুটো বক্স, আর ল্যাম্প পোষ্টগুলোতে বাঁধা পাইওনিয়ারের চোঙা মাইক। না ছিল কোন “মিক্সার”, না অন্য কোন যন্ত্রপাতি।
এখনকার দিনে বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই সহ-শিল্পীরা স্টেজে বসে তাঁদের নিজের নিজের বাদ্য যন্ত্রগুলোকে “টিউন” করেন আর মিউজিক সিস্টেমের টেকনিশিয়ান ছেলেটি তাঁদের কথামতো তার যন্ত্রটার বিভিন্ন বোতাম টিপতে থাকে । প্রধান শিল্পী নিজেও অন্ততঃ দশ মিনিট সময় নেন তাঁর নিজস্ব যন্ত্রের ও সামনে থাকা মাইক্রফোন “অ্যাডজাস্ট” করতে। আর স্টেজের দুধারে দুটো বক্স শিল্পীর দিকে মুখ করে থাকা চাই – না হলে গানই হবেনা। এতে নিশ্চয় গানের গুণগত মান অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু আগেকার দিনে এসব ছাড়াই শিল্পীদের গান গাইতে হত ।
আমাদের সেই অনুষ্ঠানে গান আরম্ভ করার আগে হেমন্ত তাঁর হারমনিয়মটা একটু বাজিয়ে নিলেন, আর তবলা বাদক তাঁর ছোট্ট হাতুড়িটা দিয়ে ঠুকে ঠুকে তবলা- বাঁয়ার সুর বেঁধে নিলেন। ব্যস এইটুকুই । সবাইকে নমস্কার করে গান শুরু হল । সমস্ত গুঞ্জন এক নিমেষে থেমে গেল।
এখন মনে পড়েনা ঠিক কি কি গান গেয়েছিলেন। শুধু মনে আছে সেদিন কোন হিন্দি গান উনি গাননি। সম্ভবতঃ একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু। বাকি সব আধুনিক গান। পরের পর গেয়ে চলেছেন একের পর এক অপূর্ব সব গান। গমগমে সেই গলার গান কাছে বসে শোনার আনন্দই অন্যরকম। নানা শ্রেণীর অগুন্তি শ্রোতার ভীড় – তাদের বেশীর ভাগই দাঁড়িয়ে – অথচ একেবারে স্তব্ধ। আশপাশের কোন বাড়ির গাড়িবারান্দা বা জানালায় সেদিন তিল্ধারণের জায়গা ছিলনা।
দেড় ঘন্টা ধরে প্রায় একনাগাড়ে গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শুধু মাঝেমাঝে জলের গ্লাস্টায় চুমুক দিচ্ছিলেন, মনে আছে। শেষ গানটা গাওয়ার পরে, যখন পুরো রাস্তাটা হাত-তালিতে ফেটে পড়ছে তখনও সুরের রেশ আর আমাদের ঘোর কাটেনি।
এরপর আরও অনেকবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছি – জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি তে ২৫শে বৈশাখের দিনে এবং অন্য অনেক অনুষ্ঠানে। একবার দিল্লিতেও। কিন্তু সেই খোলা রাস্তায় – যাকে বলে একেবারে হাটের মধ্যে তাঁর গান শোনার যে প্রথম অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল, আজ পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও তা ভুলিনি। এই অবিস্মরণীয় কণ্ঠ-শিল্পীর জন্ম শতবর্ষে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।