ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়া, ইউ টিউব ইত্যাদির দৌলতে বড়ো বড়ো মনীষীদের জীবনের অনেক নতুন নতুন ঘটনা নিয়ে নানারকম লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এতে আমরা উপকৃত হচ্ছি, কারণ অনেক অজানা তথ্য সামনে আসছে।

এমনই একটা লেখা সেদিন চোখে পড়ল। তবে এটা ঠিক সোশ্যাল মিডিয়ার সাধারণ রচনা নয়। বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ। বিষয় ‘রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীরামকৃষ্ণ’ । যেহেতু বিষয়টা আমার মতে যাঁরা “সর্বকালের শ্রেষ্ঠ” চারজন বাঙালি (ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ পরমহংস, রবীন্দ্রনাথ ও স্বামী বিবেকানন্দ) তাঁদের অন্যতম দুজনকে নিয়ে, তাই লেখাটা আগ্রহের সঙ্গে পড়লাম।

তথ্য যা পেলাম তার মধ্যে একমাত্র নতুন লাগল যেটা সেটা হচ্ছে যে ১৮৮৩ সালের ২রা মে তারিখে যখন ঠাকুর মাষ্টারমশায় অন্যান্য ভক্ত এবং রাখালের (পরবর্তীকালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ) সঙ্গে ব্রাহ্ম উৎসবে যোগ দিতে কাশীশ্বর মিত্রের বাড়িতে যান তখন উৎসবে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ শ্রী শ্রী ঠাকুরকে নিজের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত “আমার মাথানত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে” পিয়ানো সহযোগে গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন। প্রবন্ধকারের নিজের ভাষায়,

“প্রার্থনাসভার শুরুতে শ্রীরামকৃষ্ণের শিশুসুলভ অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ পিয়ানো বাজিয়ে গান শুনিয়েছিলেন ঠাকুরকে। আর সে গানটি হলো যুবক রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসংগীত, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’। নিবিষ্ট মনে সেই গান শুনতে শুনতে রামকৃষ্ণ ভাবোন্মাদ হয়েছিলেন। সবাই পরম বিস্ময়ে এক অতীন্দ্রিয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলেন সে সভায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শ্রদ্ধায় বিমোহিত হয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে ওই অবস্থা কাটিয়ে উঠে শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন সবার সঙ্গে লুচি, ডাল, তরকারি, মিষ্টি খেয়ে উপস্থিত সবাইকে, বিশেষ করে যুবক রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানিয়ে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যান।”

এই উৎসবে যে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন এবং গান গেয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  স্টেটসম্যান পত্রিকায় সে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, এবং প্রথম আলোর প্রবন্ধে সেই সংবাদ মূল ইংরাজীতেই উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্ত আলোচ্য প্রবন্ধটি ছাড়া আমরা আর অন্য কোথাও পাইনা যে সেদিন রামকৃষ্ণদেব রবীন্দ্রনাথকে “শিশুসুলভ অনুরোধ” করেছিলেন গান গাওয়ার জন্য। এবং কোন গানটি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শুনিয়েছিলেন তার কোন উল্লেখ।

আমরা জানি যে ১৮৮২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দর্শনের দিন থেকে শুরু করে ১৮৮৬ সালের আগষ্টে ঠাকুরের অদর্শনের দিনটি পর্যন্ত তাঁর জীবনের প্রায় সমস্ত প্রধান প্রধান ঘটনা, সাধারণ ভক্তবৃন্দ থেকে শুরু করে তৎকালীন বড়োবড়ো মনীষীদের সঙ্গে ঠাকুরের দেখা-সাক্ষাত ও আলাপ-আলোচনার অনন্য আকর গ্রন্থ হচ্ছে শ্রী ‘ম’ বা মাষ্টারমশায় রচিত “শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত”। এছাড়া অন্য প্রামাণিক আকর গ্রন্থের মধ্যে পড়ে স্বামী সারদানন্দের লেখা “শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ” এবং অক্ষয় কুমার সেন রচিত “শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি” । আধুনিক সময়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শ্রদ্ধেয় মহারাজদের মধ্যেও কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীরামকৃষ্ণ – এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বামী মেধসানন্দ রচিত “রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচেতনা ও শ্রীরামকৃষ্ণ”। আর অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় দীর্ঘ গবেষণা-প্রসূত শ্রী শঙ্করীপ্রসাদ বসুর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা সম্বন্ধিত বইগুলি।

এর কোনোটিতেই কিন্তু পাচ্ছিনা প্রথম আলোর প্রবন্ধে উল্লেখিত গান শোনাবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে শ্রীরামকৃষ্ণের শিশুসুলভ অনুরোধ করার এবং রবীন্দ্রনাথের ঐ বিশেষ গানটি গেয়ে শোনানোর গল্প। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে রয়েছে এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বিস্তারিত বিবরণঃ-

“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। ব্রাহ্মভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। সঙ্গে রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি আছেন। বেলা পাঁচটা হইবে।

৺কাশীশ্বর মিত্রের বাগান বাড়ি নন্দনবাগানে। তিনি পূর্বে সদরওয়ালা ছিলেন। আদি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ব্রহ্মজ্ঞানী। তিনি নিজের বাড়িতেই দ্বিতলায় বৃহৎ প্রকোষ্ঠমধ্যে ঈশ্বরের উপাসনা করিতেন, আর ভক্তদের নিমন্ত্রণ করিয়া মাঝে মাঝে উৎসব করিতেন। তাঁহার স্বর্গরোহণের পর শ্রীনাথ, যজ্ঞনাথ প্রভৃতি তাঁহার পুত্রগণ কিছুদিন ওইরূপ উৎসব করিয়াছিলেন। তাঁহারাই ঠাকুরকে অতি যত্ন করিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন।

ঠাকুর প্রথমে আসিয়া নিচে একটি বৈঠকখানাঘরে আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সে ঘরে ব্রাহ্মভক্তগণ ক্রমে ক্রমে আসিয়া একত্রিত হইয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র (ঠাকুর) প্রভৃতি ঠাকুরবংশের ভক্তগণ এই উৎসবক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন।

আহূত হইয়া ঠাকুর ভক্তসঙ্গে দ্বিতলায় উপাসনামন্দিরে গিয়া উপবেশন করিলেন। উপাসনার গৃহের পূর্বধারে বেদী রচনা হইয়াছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ইংরেজী বাদ্যযন্ত্র (Piano) রহিয়াছে।
পিয়ানো ও হারমোনিয়াম সংযোগে ব্রহ্মসঙ্গীত গীত হইতে লাগিল। সঙ্গীত শুনিয়া ঠাকুরের আনন্দের সীমা রহিল না।”

এরপরে শ্রী ‘ম’ দিয়েছেন ঐ অনুষ্ঠানের আরও এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, যেমন কি কি স্ত্রোত্র পাঠ হয়েছিল এবং স্ত্রোত্রপাঠ শুনে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবিষ্ট হওয়ার কথাঃ

“ক্রমে উদ্বোধন প্রার্থনা উপাসনা। বেদীতে উপবিষ্ট আচার্যগণ বেদ হইতে মন্ত্রপাঠ করিতে লাগিলেন:

ওঁ পিতা নোঽসি পিতা নোবোধি। নমস্তেস্তু মা মা হিংসীঃ।

তুমি আমাদের পিতা, আমাদের সদ্বুদ্ধি দাও তোমাকে নমস্কার। আমাদিগকে বিনাশ করিও না।

ব্রাহ্মভক্তেরা সমস্বরে আচার্যের সহিত বলিতেছেন:

ওঁ সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম। আনন্দরূপমমৃতংযদ্বিভাতি।
শান্তং শিবমদ্বৈতম্‌ শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।

এইবার আচার্যগণ স্তব করিতেছেন:

ওঁ নমস্তে সতে তে জগৎকারণায়
নমস্তে চিতে সর্বলোকাশ্রয়ায়। ইত্যাদি।

স্তোত্রপাঠের পর আচার্যেরা প্রার্থনা করিতেছেন:

অসতো মা সদ্‌গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মাহমৃতং গময়। …আবিরাবীর্ম এধি।
…রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্।

স্ত্রোত্রাদি পাঠ শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন।”

এরকম  অনুপুঙ্খ বিবরণ যিনি  দিয়েছেন, তিনি কি অনুষ্ঠানের শুরুতে শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরোধ অথবা রবীন্দ্রনাথের গাওয়া গানটির কথা উল্লেখ করতেন না? ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয়েছিল, সেকথা আমরা পাচ্ছি। কিন্তু আমার মতে শ্রীরামকৃষ্ণের শিশুসুলভ অনুরোধ এবং রবীন্দ্রনাথের ঐ বিশেষ গানটি গাওয়ার গল্পটা প্রবন্ধকারের নিজস্ব অনুমান মাত্র। আসলে ঐ গানটি সেদিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে গাওয়াই সম্ভব ছিলনা। কেন, তা পরে বলছি।

এবারে সেদিন ঠাকুরের লুচি, ডাল, তরকারি, মিষ্টি খেয়ে উপস্থিত সবাইকে, বিশেষ করে যুবক রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানিয়ে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যাওয়ার গল্প। দেখা যাক এ ব্যাপারে কথামৃতকার কি বলছেনঃ


রাত নয়টা হইল। ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ফিরিয়া যাইতে হইবে। গৃহস্বামীরা আহূত সংসারীভক্তদের লইয়া খাতির করিতে করিতে এত ব্যতিব্যস্ত হইয়াছেন যে, ঠাকুরের আর কোন সংবাদ লইতে পারিতেছেন না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখাল প্রভৃতির প্রতি) – কিরে কেউ ডাকে না যে রে!

রাখাল (সক্রোধে) – মহাশয়, চলে আসুন, দক্ষিণেশ্বরে যাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – আরে রোস্। গাড়িভাড়া তিন টাকা দুআনা কে দেবে! রোখ করলেই হয় না। পয়সা নাই আবার ফাঁকা রোখ! আর এত রাত্রে খাই কোথা!

অনেকক্ষণ পরে শোনা গেল, পাতা হইয়াছে। সব ভক্তদের এককালে আহ্বান করা হইল। সেই ভিড়ে ঠাকুর রাখাল প্রভৃতির সঙ্গে দ্বিতলায় জলযোগ করিতে চলিলেন। ভিড়েতে বসিবার জায়গা পাওয়া যাইতেছে না। অনেক কষ্টে ঠাকুরকে একধারে বসানো হইল।

স্থানটি অপরিষ্কার। একজন রন্ধনী-ব্রাহ্মণী তরকারি পরিবেশন করিল। ঠাকুরের তরকারি খাইতে প্রবৃত্তি হইল না। তিনি নুন টাক্‌না দিয়া লুচি খাইলেন ও কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন গ্রহণ করিলেন।

ঠাকুর দয়াসিন্ধু। গৃহস্বামীদের ছোকরা বয়স। তাহারা তাঁহার পূজা করিতে জানে না বলিয়া তিনি কেন বিরক্ত হইবেন? তিনি না খাইয়া চলিয়া গেলে যে, তাহাদের অমঙ্গল হইবে। আর তাহারা ঈশ্বরকে উদ্দেশ করিয়াই এই সমস্ত আয়োজন করিয়াছে।

আহারান্তে ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। গাড়িভাড়া কে দিবে? গৃহস্বামীদের দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে না। ঠাকুর গাড়িভাড়া সম্বন্ধে ভক্তদের কাছে আনন্দ করিতে করিতে গল্প করিয়াছিলেন –

‘গাড়িভাড়া চাইতে গেল। তা প্রথমে হাঁকিয়া দিলে! তারপর অনেক কষ্টে তিন টাকা পাওয়া গেল, দুআনা আর দিলে না! বলে, ওইতেই হবে।’ “

এই হল ডাল -লুচি-তরকারি-মিষ্টি খেয়ে রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ করে বিদায় জানানোর আসল ঘটনা।

এবার আসি “আমার মাথা নত করে দাও…” গানটির প্রসঙ্গে। প্রথম আলোর প্রবন্ধকার নিঃসংশয়ে লিখেছেন এই গানটিই সেদিন রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন।

রবীন্দ্র-রচনাবলীতে এই গানটি সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা হলঃ

“রাগ: ইমনকল্যাণ
তাল: তেওরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1313
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1906
স্বরলিপিকার: কাঙ্গালীচরণ সেন

৪৯২

আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।
যাচি হে তোমার চরম শান্তি, পরানে তোমার পরম কান্তি,
আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥”

অর্থাৎ গানটি কবিগুরু লিখেছিলেন ১৯০৬ সালের কোনো এক সময়ে। আর নন্দনকাননে ব্রাহ্ম উৎসবের দিন নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই – না কথামৃতে না স্টেটসম্যানের খবরে, না আলোচ্য প্রবন্ধে। সেদিন টা ছিল ১৮৮৩ সালের ২রা মে। অর্থাৎ প্রবন্ধকারের মতে সেদিনের সভায় রবীন্দ্রনাথ গানটি পরিবেশন করেন সেটি লেখার ১২ বছর আগে ! 

কাজেই, প্রবন্ধকারের দেওয়া তথ্যগুলির প্রত্যেকটাই হয় অর্ধসত্য নয়তো লেখকের কল্পনা-প্রসূত, কারণ কোন আকর গ্রন্থেই এর সমর্থন পাওয়া যাচ্ছেনা।

এইধরণের ভুল তথ্য পরিবেশন করে প্রথম আলোর কি লাভ হয়েছে বলতে পারিনা; প্রবন্ধকার অবশ্যই তাঁর পরিচিত মহলের বাহবা পেয়েছেন, কারণ এটি ইন্টারনেট ও হোয়াটস্যাপের দৌলতে ভালোই ছড়িয়ে পড়েছে।

কিন্তু আমরা যারা শ্রী শ্রী ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়কেই শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, তারা দুঃখ পেয়েছি তাঁদের কথা ভেবে যাঁরা ইন্টারনেটে বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যগুলিকে বিনা প্রশ্নে সত্যি বলে বিশ্বাস করেন ।


*******