উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস । কথাটা বহু ব্যবহারে মলিন হয়ে গেলেও এর সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। এখানকার ইঁট বেরকরা পুরনো নোনাধরা কিছু বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে।

কালের নিয়মে পরিবর্তন এসেছে শহরের এই প্রাচীন পাড়াগুলোতেও। শুধু পুরনো রাস্তার বা পাড়ার নামগুলো রয়ে গেছে। যেমন রয়ে গেছে পুরনো কিছু সুদৃশ্য অট্টালিকা আধুনিক বহুতলের পাশাপাশি, নবীন ধনী মানুষের কুরুচিকর প্রদর্শনীর পাশে প্রাচীন আভিজাত্যের গাম্ভীর্যের মতো।

আজকের ঝামাপুকুর লেনের একাংশ

ঝামাপুকুর কলকাতার এমনই একটি প্রাচীন পাড়া, যেখানে বাংলা তথা ভারতবর্ষের অনেক ঐতিহাসিক চরিত্র তাঁদের জীবনের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন। এঁদের কেউ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, কেউ ধর্ম আন্দোলনের নেতা, কেউ নিছকই জমিদার, ব্যবসায়ী, কেউ অগ্নি-যুগের বিপ্লবী আবার কেউ খেলার জগতের প্রবাদপ্রতিম মানুষ।

আমার জন্ম থেকে অনেকটা সময় এই পাড়াতেই কেটেছে । তাই এখানকার বহু বাড়ির সঙ্গে যে সব বিখ্যাত মানুষের নাম এবং জীবন জড়িয়ে রয়েছে সে সম্বন্ধে আমার বাড়তি আগ্রহ। এই ইতিহাসের অনেকটাই প্রাচীন মানুষদের কাছে শোনা, নানা বইপত্রে পড়া আর অল্প একটু নিজের চোখেও দেখা।

এই পরিক্রমা শুরু করার আগে বলে রাখা ভাল “ঝামাপুকুর” বলতে আমি কলকাতার ঠিক কোন অঞ্চলটার কথা বলছি। ঝামাপুকুর লেন নামের রাস্তাটা অবশ্যই এর মধ্যে পড়বে। কিন্তু বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীট ও আমহার্স্ট স্ট্রীটের কিছু অংশকেও ঝামাপুকুরের অংশ বলেই ধরে নিতে হবে।

ঝামাপুকুর লেনের স্কেচ ম্যাপ

(১) ঝামাপুকুর রাজবাড়ি, (২) যাদবচন্দ্র দাশের মিষ্টির দোকান, (৩) শ্যামসুন্দর তলার মন্দির, (৪) ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল, (৫) বরদা কুটীর ও চমৎকার বাড়ী (দেব সাহিত্য কুটীর)
(৬) ১৮ নং ঝামাপুকুর লেন, (৭) ৮৭ নং কেশব চন্দ্র সেন ষ্ট্রীট, (৮) ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির, (৯) মর্টন স্কুল (হিন্দু একাডেমী), (১০) এইচ বোসের বাড়ি, (১১) সিটি কলেজ

কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীট থেকে শুরু হয়ে ঝামাপুকুর লেন সোজা উত্তরে গিয়ে বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে পড়েছে। এই পথের একটা শাখা এর প্রায় মাঝামাঝি জায়গা থেকে বেরিয়ে পূর্ব দিকে একটা “টি জংশন” থেকে আবার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। উত্তরের অংশটি আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে আসা সুবল চন্দ্র লেনের সঙ্গে মিলে আবার বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে গিয়ে মিশেছে। আর দক্ষিণের ভাগটি কিছুটা এঁকেবেঁকে কেশব চন্দ্র স্ট্রীটের অংশ হয়ে দক্ষিণে মূল কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীটে গিয়ে শেষ হয়েছে। মোটামুটি এই অঞ্চলটুকুতেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ, যদিও আরও উত্তরের কিছু অংশ পুরনো যুগে সম্ভবত ঝামাপুকুর নামেই পরিচিত ছিল। বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটের কিছু উত্তরে “ঝামাপুকুর পার্ক”এর নামেই সেই ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু ঐ জায়গাগুলো “বাহির সিমলা” বা “বার সিমলে” বলেই বহুল পরিচিত। তাই আমাদের আলোচনা থেকে ঐ অঞ্চলকে বাদ দিয়েছি।

এই আয়তক্ষেত্রটির আয়তন কত হবে বলতে পারিনা, তবে সাধারণ একজন মানুষের এই পুরো অঞ্চলটা একবার ঘুরে আসতে বড়জোর আধঘন্টারও কম সময় লাগবে। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরের মধ্যেই রয়েছে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের এক বিচিত্র ভান্ডার।

যে কোন স্থানের ইতিহাস রচিত হয় সে অঞ্চলের কোন না কোন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবন বা পরিবারের কাহিনী অবলম্বন করে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী ঝামাপুকুরের ইতিহাস এখনও অজানা। তাই মোটামুটি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১০০ বছরের কিছু বেশী সময়ে যে সমস্ত ঐতিহাসিক চরিত্র এই অঞ্চলে বাস করেছেন তাঁদের জীবন ও সমসাময়িক কিছু উল্লেখনীয় ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায় সে কালের কলকাতার যে অঞ্চলগুলো শহরের পশ্চিম দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগিরথী নদী থেকে দূরে ছিল সেগুলোতে ছোট বড় অনেক পুকুর দেখা যেত। সেরকম একটি অন্তত পুকুর যে এই পাড়ায় ছিল ঝামাপুকুর নাম থেকেই তা স্পষ্ট।

আমরা যে সময়ের ঝামাপুকুরের কথা বলছি তখন শহরেগ্যাসের আলো এসে গেছে (১৮৫৭), পাকা ড্রেন পাতা শুরু হয়েছে (১৮৭০), পাইপের জলসরবরাহ শুরু হয়েছে, এবং পরে এসেছে বিদ্যুতের আলো (১৮৯৯)। সেই সময় কলকাতার এই অংশটি যে একটি বর্ধিষ্ণু এবং অভিজাত অঞ্চল ছিল তাতে সন্দেহ নেই।

আবার পাকা বাড়ি ও অট্টালিকার পাশাপাশি অনেক মাটির দেওয়াল ও খোলার চালের বাড়িও ছিল এ পাড়ায়, যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় স্বামী সারদানন্দের বিখ্যাত “শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ” গ্রন্থে।

এই পল্লীর সবচেয়ে পরিচিত বাড়িটি — ঝামাপুকুর রাজবাড়ি দিয়েই আমাদের পরিক্রমা শুরু ।

ঝামাপুকুর রাজবাড়ি – রাজা দিগম্বর মিত্র (১৮১৭-১৮৭৯)

১ নম্বর ঝামাপুকুর লেনের এই বাড়ি ঝামাপুকুর রাজবাড়ি নামেই পরিচিত। যাঁর নামে বাড়িটির রাজবাড়ি অভিধা, সেই দিগম্বর মিত্র কিন্তু কোন দেশীয় রাজা ছিলেন না।
কোন্নগরের শিবনাথ মিত্রের পুত্র দিগম্বর হেয়ার স্কুল ও হিন্দু কলেজে রামতনু লাহিড়ীর সহপাঠী এবং বাংলার নবজাগরণের প্রেরণা-পুরুষ অধ্যাপক ডিরোজিও সাহেবের ছাত্র। অথচ প্যারীচাঁদ মিত্র ডিরোজিওর অন্তরঙ্গ ছাত্রমন্ডলীর যে তালিকা দিয়েছেন – যাঁদের সে যুগে “ইয়ং বেঙ্গল” বলা হত – সে তালিকায় দিগম্বর মিত্র অনুপস্থিত, যদিও বন্ধু ও একই ক্লাসের ছাত্র রামতনু লাহিড়ী এই তালিকায় আছেন। তবে তিনি যে এই দলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।

প্রথম জীবনে শিক্ষকতা থেকে শুরু করে দিগম্বর মিত্র অনেক বড় বড় জমিদারের ম্যানেজারীও করেন। কিছুদিন রাজশাহীতে ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে কেরানীর কাজও করেছিলেন। পরে নীল ও রেশমের ব্যবসায়ে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন।

ব্যবসার কারণে তাঁকে কলকাতার বাইরে থাকতে হত, কিন্তু ১৮৫০ সাল নাগাদ তিনি কলকাতায় এসে প্রথমে তাঁর বাগমারী বাগানে থাকতে শুরু করেন। পরে কিছু দিন সার্কুলার রোডে “লিচু বাগান” অঞ্চলে ও ঝামাপুকুরে বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে বাস করেন এবং ১৮৫৩ সালে ১ নম্বর ঝামাপুকুর লেনের বাড়িটি কেনেন। কিন্তু এই বাড়ির পূর্বতন মালিক কে ছিলেন তা দিগম্বরের জীবনীকার জানান নি।

দিগম্বর মিত্র ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রধানত জমিদার ও বিত্তবান ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান বৃটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সচিব পদাধিকারি হন এবং ১৮৭৩ সালে এর সভাপতি হন। ১৮৭৪ সালে তিনি কলকাতার শেরিফ হন । তিনিই ছিলেন শহরের প্রথম বাঙালি শেরিফ। বৃটিশ সরকার ১৮৭৬ সালে তাঁকে Companion of the Star of India (CSI) এবং ১৮৭৭ সালে “রাজা” উপাধি দেন।

ডিরোজিওর ছাত্র হলেও রাজা দিগম্বর মিত্র ছিলেন গোঁড়া হিন্দু এবং বিধবা বিবাহের বিরোধী। তবে শিক্ষা প্রসার এবং অন্যান্য জনহিতকর কাজে তিনি অর্থ সাহায্য করতেন।

আজকের ঝামাপুকুর রাজবাড়ি দেখে এর প্রাচীন রূপটি কল্পনা করা অসম্ভব। এই বিশাল বাড়িটি এখন অনেক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এর কোন কোন অংশ বিক্রী হয়ে সেখানে উঠেছে আধুনিক ছাঁদের কিছু ইমারত।

এর গৌরবের দিনে রাজবাড়িটি কেমন ছিল তার আভাস পাওয়া যায় ঝামাপুকুর লেন থেকে এর পুরনো অংশে ঢুকলে। সেই সুন্দর চৌকোণা উঠোন, ঠাকুর দালান, কারুকার্য করা থাম ও পঙ্কের পালিশ করা দেওয়ালে বিদেশী টালির কিছু কিছু আজও রয়ে গেছে। বাড়িটির এই অংশেই রয়েছে ‘ঝামাপুকুর রামকৃষ্ণ সংঘ”।

ঝামাপুকুর রাজবাড়ির প্রাচীন রূপ

এখানেই শ্রী রামকৃষ্ণ মিত্রপরিবারের গৃহদেবতার নিত্যপূজা করতেন বলে জানা যায়। প্রবেশপথের দেওয়ালের প্রস্তর ফলকটি জানাচ্ছে এই রাজবাড়ির বিখ্যাত হয়ে ওঠার প্রধান কারণ।

যদু ময়রার দোকান

শ্রী রামকৃষ্ণের পুণ্য স্মৃতিধন্য বলেই ঝামাপুকুরের বিশেষ আকর্ষণ অগণিত মানুষের কাছে। সেই প্রসঙ্গে আসার আগে ঝামাপুকুরের আর একটি প্রাচীন ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানের কথা বলে নিই। শ্রী রামকৃষ্ণের সুবাদে এই প্রতিষ্ঠানটিও ইতিহাসে তার স্থান করে নিয়েছে।

ঝামাপুকুর রাজবাড়ির ঠিক উল্টো দিকে কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীটের একেবারে মুখে আজও রয়েছে দেড়শো বছরেরও বেশী পুরনো এক বিখ্যাত মিষ্টির দোকান “যাদব চন্দ্র দাশ” । সে যুগের মানুষ একে যদু ময়রার দোকান বলেই জানত, এবং শ্রী শ্রী ঠাকুর যে এঁদের তৈরী মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন “কথামৃতে” তার উল্লেখ আছে। এখন কলকাতার অন্যত্র এই দোকানের শাখা হয়েছে, কিন্তু আদি দোকানটি আজও তার ঐতিহ্য বুকে নিয়ে ঝামাপুকুরেই দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

ঝামাপুকুরে শ্রী রামকৃষ্ণ

যাঁর নামের সঙ্গে ঝামাপুকুর এবং ঝামাপুকুর রাজবাড়ি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, আর আজও অগণিত ভক্ত যাঁর টানে ঝামাপুকুরে আসেন, সেই পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ তাঁর জীবনের দু’ বছরের কিছু বেশী সময় এই অঞ্চলে কাটিয়েছিলেন । তখনও তাঁর “রামকৃষ্ণ” নামকরণ হতে অনেক দেরী। তিনি তখন “গদাধর” বা “গদাই” নামেই পরিচিত।

পিতা ক্ষুদিরামের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৮৫০ সালে বড় ছেলে রামকুমার কামারপুকুর ছেড়ে কলকাতার ঝামাপুকুরে একটি টোল বা চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং রাজা দিগম্বর মিত্রের এবং আরও কয়েকটি বাড়িতে নিত্যপূজার ভার নেন। রামকুমারের চতুষ্পাঠী ছিল ৬১ নম্বর বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে।

এঁদের গৃহদেবতা রাধা-গোবিন্দ বা শ্যাম-সুন্দরের নিত্যপূজাও তিনিই করতেন। পরে এই মন্দিরটি পাশেই ৬০বি বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে স্থানান্তরিত হয় এবং আজও সেখানেই রয়েছে। শ্যামসুন্দর তলা নামে পরিচিত এই জায়গায় ঝামাপুকুর তথা কলকাতার একটি অতি প্রাচীন সাবেকি দুর্গাপুজোও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল।

শ্যামসুন্দরতলার মন্দির

কয়েক বছর পরে (১৮৫২/৫৩) রামকুমার গদাধরকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং তাকে নিজের টোলে শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। তখন গদাধরের বয়স ষোল বছরের কিছু বেশী। প্রথাগত লেখাপড়ায় তাঁর মন না থাকায় রামকুমার তাঁকে তিরস্কারও করতেন। একদিন গদাধর স্পষ্ট ভাষায় “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা” শিক্ষায় অনিচ্ছা প্রকাশ করলে রামকুমার মনঃক্ষুণ্ণ হলেও তাঁকে লেখাপড়ার জন্য বাধ্য না করে নিজের যজমানদের নিত্যপূজাগুলির ভার তাঁর উপর দিয়ে নিজে অধ্যাপনায় মনোনিবেশ করেন । গদাধর তাঁর সরল ব্যবহার, পূজায় পারদর্শিতা এবং মধুর ভজনের দ্বারা সহজেই মিত্রপরিবারের ও অন্যান্য পল্লীবাসীদের প্রিয় হয়ে ওঠেন।

ঝামাপুকুরে শ্রী রামকৃষ্ণ দু’বছরের কিছু বেশী সময় ছিলেন। ১৮৫৫ সালে রাণী রাসমণির দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেখানকার পূজকের ভার নেন এবং গদাধর সহ সেখানে বাস করা শুরু করেন। এই দক্ষিণেশ্বরেই দীর্ঘ এবং কঠোর সাধনার পরে গদাধর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। সে অন্য ইতিহাস।

ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল

শ্যামসুন্দর তলা থেকে ঝামাপুকুর লেন ধরে দক্ষিণ-মুখো কয়েক পা হাঁটলেই ডানহাতে ৩১ নম্বর ঝামাপুকুর লেন। এই বাড়িতে ১৯০৪ সালে ব্রাহ্ম সমাজের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল যা এখনও এই বাড়িতেই রয়েছে। ভারতে সংখ্যাবিজ্ঞানের জনক বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ ঐতিহ্যপূর্ণ এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন এবং স্বল্পসময় এখানে শিক্ষকতাও করেছেন । স্কুলের প্রাচীন ছাত্রদের মুখে শুনেছি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এই স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন।

দেব সাহিত্য কুটীর – চমৎকার বাড়ী

ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল ছাড়িয়ে আর একটু দক্ষিণ দিকে রাজবাড়ির একটু আগে ঝামাপুকুর লেনের একটা শাখা পূর্ব দিকে চলে গেছে এবং কিছুটা গিয়ে একটা “টি জংশন” থেকে আবার উত্তর দক্ষিণে ভাগ হয়ে গেছে। এই পথের উত্তরের অংশটি আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে আসা সুবল চন্দ্র লেনের সঙ্গে মিশে বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে গিয়ে পড়েছে। আর দক্ষিণের অংশটি ৮৭ নম্বর কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীটে গিয়ে শেষ হয়েছে। তার পর একটা সরু গলি মূল কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীটে গিয়ে মিশেছে।

এই “টি” জংশনের” উপরেই “বরদা কুটীর” এবং তার ঠিক দক্ষিণে ২১ নম্বর ঝামাপুকুর লেন। নাম – “চমৎকার বাড়ী” । প্রধানত এই দুটী বাড়িতেই দেবসাহিত্য কুটীরের যাবতীয় প্রকাশনার কাজ হত। “চমৎকার বাড়ী”তে ঢুকে ডান হাতে প্রথম ঘরটাতেই ছিল মূল অফিস।

বাংলা বইয়ের প্রকাশনার জগতে ২১ নম্বর ঝামাপুকুর লেন এক অতি পরিচিত ঠিকানা। এখান থেকেই গত প্রায় এক শতাব্দী ধরে দেব সাহিত্য কুটীরের অজস্র বই প্রকাশিত হয়ে আসছে। এই ঠিকানা থেকে গত সত্তর বছরের বেশী সময় প্রকাশিত হচ্ছে ‘শুকতারা’ এবং তার চেয়ে একটু বয়ঃকনিষ্ঠ ‘নবকল্লোল’ পত্রিকা দুটি; এবং আজও পত্রিকাদুটি সমান জনপ্রিয়।

শুকতারা-নবকল্লোল, পূজা-সংখ্যাগুলো, অভিধান, রামায়ণ-মহাভারত, বিশ্ব পরিচয়, গোয়েন্দা কাহিনী ইত্যাদি ছাড়াও দেব সাহিত্য কুটীরের যে অবদানটি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে তা হচ্ছে এঁদের ছোটদের জন্য প্রকাশিত অনুবাদ সাহিত্য। সুধীন্দ্র রাহা, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ জনপ্রিয় লেখকদের অনুবাদে বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সব গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে কিশোর পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া – তাও অবিশ্বাস্য অল্পদামে – নিশ্চয় ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে একটা সাহিত্য-রসিক মনেরও পরিচয় দেয়।

এখন অবাক হই অত বড়ো বড়ো বইগুলোকে কী দক্ষতায় অনুবাদকরা বন্দী করতেন খুব বেশী হলে একশ পাতার মধ্যে। তাঁরা অবশ্যই কাহিনীগুলোর বহু অংশ নির্মম ভাবে ছেঁটে ফেলতেন। কিন্তু সেই বয়সে আমরা সারা পৃথিবীর দিকপাল সব লেখকদের সৃষ্টিগুলোর একটু পরিচয় তো পেতাম !


চমৎকার বাড়ী

দেব সাহিত্য কুটীরের শুরুর কাহিনীটা ছিল কঠিন পরিশ্রমের। বরদাপ্রসাদ মজুমদারের (১৮৩২-১৯১২) পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হাওড়ার পাঁতিহালে। শৈশবে পিতৃবিয়োগ হলে তিনি মায়ের সঙ্গে কাশীতে বাস করেন। ১৮৬০ সালে কলকাতায় এসে প্রথমে বই বিক্রী এবং পরে “কাব্য প্রবেশিকা” নাম দিয়ে সংস্কৃত বই প্রকাশ করা শুরু করেন।

বি পি এম প্রেস নামের এই প্রকাশন পরবর্তী কালে তাঁর তৃতীয় পুত্র আশুতোষ দেবের হাতে দেব সাহিত্য কুটীর রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় এবং আরও কয়েকটি বইয়ের সত্ত্ব কেনা থেকেই (সম্ভবত ১৯২৪ সালে) এই প্রকাশনা সংস্থানের জয়যাত্রা শুরু। সংস্থাটি আইন অনুসারে পঞ্জীকৃত হয় ১৯২৮ সালে।

সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ঝামাপুকুর

দেব সাহিত্য কুটীর থেকে দক্ষিণ দিকে গেলে ঝামাপুকুর লেন শেষ হয়েছে ১৮ নম্বর বাড়িতে। এই বাড়িটিই এদিকে ঝামাপুকুর লেনের শেষ বাড়ি, কিন্তু এর আরও দুটো দরজা আছে পুর্ব দিকে। কিন্তু এই অংশটা মাটির, অর্থাৎ এটা একটা ব্যক্তিগত রাস্তা। এবং এই ১৮ নম্বরের পরেই শুরু হয়েছে কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটের একটা শাখা যার প্রথম প্লটটির নম্বর ৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট।

এই দুই বাড়ির মধ্যে একটা কাঁটাতার দেওয়া ইটের পাঁচিল এবং একটা লোহার গেট ছিল। আর ব্যক্তিগত রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে ছিল একটা কাঠের দরজা। পাঁচিলটা এখনও আছে। গেটটা আর কাঠের দরজাটা আছে কিনা বলতে পারিনা। কয়েকটা কাঠালীচাঁপা, শিউলী আর গন্ধরাজ ফুলের গাছ ছিল এই মাটির জমিটাতে। হঠাৎ দেখলে মনে হতো জায়গাটা কলকাতার বাইরে। এর মধ্যে কয়েকটা গাছ এখনও আছে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিরিশ বছরকে অগ্নিযুগ বলা চলে। এসময় সারা দেশে গড়ে ওঠে অসংখ্য গুপ্ত সমিতি। ঝামাপুকুরের এই অঞ্চলে এই সব বিপ্লবী গোষ্ঠীর বহু কর্মী-সদস্য গোপনে বাস করতেন। আর তাঁদের খোঁজে এ পাড়ায় পুলিশে হানা ছিল নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা।

এখানকার প্রাচীন মানুষদের মুখে শোনা, সম্ভবত ১৯২৮-২৯ সাল থেকে কয়েক বছর নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রিয় শিক্ষক বিখ্যাত বেণীমাধব দাস সপরিবারে এই ১৮ নম্বর ঝামাপুকুর লেনে বাস করতেন। সালটা সঠিক কিনা বলতে পারিনা, আর যাঁদের কাছে এই কথা শোনা তাঁরা কেউ আর এ জগতে নেই।

বীণা দাস

বেণীমাধব দাসের কনিষ্ঠ কন্যা বীণা দাস (১৯১১-১৯৮৬) ছোটবেলাতেই নিজেদের বাড়িতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সংস্পর্শে আসেন। কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় (১৯২৮) তিনি সুভাষ চন্দ্রের সংগঠিত বেঙ্গল ভলান্টীয়ার্সের সভ্য হন। বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রীসংঘ নামে এক সংগঠনের সদস্য হন। বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও এটি কোন গুপ্ত সমিতি ছিল না।

কলেজেরই একজন ছাত্রী তাঁকে একটি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির সভ্য করেন, কিন্তু বীণা তাঁর আত্মজীবনী-মূলক বই “শৃঙ্খল ঝঙ্কার”-এ এই সমিতিটির নাম বা এর নেতা-নেত্রীদের নাম প্রকাশ করেননি। তবে তিনি যে এইসময় বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে ছিলেন তা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন। বীণার দিদি কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য)ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং কারাবরণ করেছিলেন।

অত্যাচারী বৃটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির দাবীর প্রতি দেশের তথা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে বীণা ১৯৩২ সালের ৬ই ফেরুয়ারী বাংলার তৎকালীন গভর্ণর স্ট্যানলী জ্যাকশন কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব চলাকালীন গুলি করেন, কোন ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে নয়। তাঁর জবানবন্দীতে বীণা একথা বলেছিলেন।

গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, বীণা ধরা পড়েন। তখন তাঁর বয়স ২১ বছর। পুলিশের হেফাজতে থাকার সময়ে তাঁর উপর যে নির্মম অত্যাচার করা হয় তার উল্লেখ রয়েছে বীণার আত্মজীবনীতে।

দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্ত হয়ে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন, বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, ছেচল্লিশের দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীশচন্দ্র ভৌমিক কে বিয়ে করেন। সরকারের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর তাম্রফলক তিনি নেন নি, যদিও পদ্মশ্রী খেতাব পেয়েছিলেন ।

শেষ জীবনে অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে ঋষিকেশে তাঁর মৃত্যু হয়। লজ্জার কথা, স্বাধীন দেশের সরকার দেশের এই বীর কন্যার মৃতদেহ কে সনাক্ত পর্যন্ত করতে পারেননি।

তাঁর আত্ম-জীবনী-মূলক বই “শৃঙ্খল ঝঙ্কার” একদিকে যেমন সে যুগের বিপ্লবীদের অদম্য দেশপ্রেম, অতুলনীয় আত্মত্যাগ,, সাহসিকতা ও মানসিক শক্তির কাহিনী তেমনই এতে রয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী আশাভঙ্গের বেদনার ছোঁয়াও ।

এই ১৮ নম্বর ঝামাপুকুর লেনের অন্য এক অংশে আর একজন বিপ্লবী বাস করতেন। তিনি পরিচিত ছিলেন “মধুবাবু” নামে। আসল নাম কেউ জানতো না। পাড়ার কিশোর-যুবকদের তিনি মাঝে মাঝে খালি হাতে আত্মরক্ষার নানা কায়দা শেখাতেন। ইনি ছদ্মবেশ ধারণে নিপুণ ছিলেন এবং কখনও ফুলবাবু, আবার কখনও ঝুলি-কাঁধে কাবুলীওয়ালা বেশে ঘোরাফেরা করতেন। পুলিশী অভিযান প্রায়ই হত এ বাড়িতে, কিন্তু মধুবাবু কখনও ধরা পড়েন নি।

১৮ নম্বর ঝামাপুকুরের ঠিক পূর্বদিকে ৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন ষ্ট্রীটের ‘তেতলা’ বাড়িটির উপরেও পুলিশের নেকনজর ছিল। এই ৮৭ নম্বরের জমিটির তিনটি অংশ । উত্তরের তিনতলা বাড়িটিই আদি বাড়ি। এর দক্ষিণে একই নম্বরে একটা নতুন দোতলা বাড়ি, এবং সর্ব দক্ষিণে একটা লাল ইটের একতলা বাড়ি।

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মধ্যে বিখ্যাত নাম পুলিনবিহারী দাস (১৮৭৭-১৯৪৯)। ঢাকার অনুশীলন সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই বিপ্লবী যুবকদের লাঠি ও তরোয়াল খেলা ও শরীর চর্চা ছাড়াও সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে উদবুদ্ধ করতেন। ১৯০৮ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জে একটি স্বদেশী ডাকাতির মামলায় তাঁর দু বছরের জেল হয়। ১৯১০ সালে মুক্তি পেতেই তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয় “ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায়। এবার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা পেয়ে তাঁর স্থান হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৮ সালে বিশেষ বন্দি মুক্তিতে পুলিন দাস ছাড়া পান। তখন সশস্ত্র সংগ্রাম ও গুপ্তহত্যার রাজনীতিতে মানুষ আস্থা হারিয়েছে। অনুশীলন সমিতি লুপ্তপ্রায়। তিনি সমিতির পুনর্গঠন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং কলকাতার ঝামাপুকুরে ১৯২০ থেকে কয়েক বছর ৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটের তিনতলা বাড়ির একটি অংশে ভাড়া ছিলেন তাঁর কিছু অনুগামীদের সঙ্গে।

এই সময়ে তিনি হক-কথা ও স্বরাজ নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা চালাতেন। ১৯২২ সালে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে পুলিনবিহারী ঝামাপুকুরের কাছেই একটি পাড়ায় বাস করা শুর— করেন এবং সেখানে বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি নামে একটি ব্যায়ামাগার স্থাপন করেন। তিনি যে রাস্তায় থাকতেন বর্তমানে তার নাম বিপ্লবী পুলিন দাস স্ট্রীট।

পুলিন দাস ৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটে আসার আগেই এই বাড়িটিতে পূর্ববঙ্গের কিছু মানুষ মেস করে থাকতেন। মাঝেমাঝেই নতুন নতুন মুখ সেখানে দেখা যেত, যারা কিছুদিন পরেপরেই অদৃশ্য হয়ে যেত আর তার পরেই আসত পুলিশ। স্বদেশী বিপ্লবীদের ঘাঁটি হিসেবে সেই সময়ের ঝামাপুকুর পরিচিত ছিল।

কলকাতার ফুটবল ও ঝামাপুকুর

৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটের জমিটা কলকাতার ফুটবলের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে। এর দক্ষিণ অংশে যে একতলা লাল ইটের বাড়ির কথা বলেছি, সেই বাড়িটিতে থাকতেন বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের এক কিংবদন্তি খেলোয়াড় হাবুল (শ্রীশ চন্দ্র) সরকার (১৮৮৮-১৯৬১) – আমার বাবার বড় মামাবাবু, আমার বড়দাদু । ১৯০৯ সালে তিনি মোহনবাগান ক্লাবে যোগ দেন।

বসে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি হাবুল সরকার – পায়ের কাছে ছোট কাপ

১৯১১ সালে মোহনবাগান ক্লাবের যে দল প্রথম আই এফ এ শীল্ড জিতে ইতিহাস গড়ে ছিল, হাবুল (শ্রীশচন্দ্র) সরকার ছিলেন সেই দলের রাইট-ইন । ১৯১৩ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত হাবুল সরকার মোহনবাগান ফুটবল দলের অধিনায়কও ছিলেন।

শুধু ফুটবল নয়, হাবুল সরকার একজন সুদক্ষ হকি খেলোয়াড় ছিলেন। হকি খেলার শুরু গ্রীয়ার ক্লাবে। পরে মোহনবাগান ক্লাবে যোগ দেন এবং সেই বছরই মোহনবাগান প্রথম ডিভিসনে উন্নীত হয়। এছাড়া তিনি সিটি এথলেটিক ক্লাব, স্পোর্টিং ইউনিয়ন ও টাউন ক্লাবে ক্রিকেট খেলতেন।

চন্দন নগরের আদি বাড়ি ছেড়ে কলকাতা কর্পোরেশনের চাকরী নিয়ে হাবুল ঝামাপুকুরে তাঁর আত্মীয় সাতকড়ি বসুর ৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটের এক অংশে বিধবা মাকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। এখান থেকেই তিনি খেলতে যেতেন ময়দানে, এবং আজীবন এই ঠিকানাতেই বাস করেছেন। তাঁর বোন ও ভগ্নীপতি অল্পবয়সে মারা গেলে বড়দাদু আমার বাবা ও তাঁর দুই বড় ভাই এবং দুই বোনকে পাটনা থেকে নিজের কাছে এনে রাখেন।

১৯৬১ সালে বড়দাদু যখন মারা যান আমি তখনও স্কুলে ভর্তী হইনি। আমার শুধু মনে আছে সেদিন অগুন্তি মানুষ আর ফুলে ভরে গিয়েছিল আমাদের বাড়ি । তখনকার বাংলার খেলার জগতের সব দিকপালেরাই এসেছিলেন ১৯১১র “যোদ্ধা” হাবুল সরকারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ মন্দির

৮৭ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট থেকে একটা সরু গলি যেখানে মূল কেশবচন্দ্র সেন ষ্ট্রীটের সঙ্গে মিশেছে ঠিক তার বাঁ দিকে ৯৫ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে ১৫১ বছরের পুরনো ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ মন্দির।

আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রাণ-পুরুষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪) বাংলার ধর্ম আন্দোলনের ইতিহাসে বিখ্যাত চরিত্র। তাঁর নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন বাংলার গন্ডী ছাড়িয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে নানা ব্যাপারে মহর্ষির সঙ্গে কেশবের মতভেদ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৮৬৬ সালে কেশবচন্দ্র সংগঠিত করেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ। ১৮৬৯ সালে ৯৫ নম্বর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীটে এই সমাজের মন্দিরটির উদ্বোধন করেন।

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ মন্দির

অনেক টানাপোড়েনের পর ঝামাপুকুরের এই ব্রাহ্ম মন্দিরেই প্রথম মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি উপাসনায় যোগ দেওয়ার অধিকার পান, কিন্তু পর্দার আড়াল থেকে। ক্রমে স্ত্রীশিক্ষা, উপাসনাকালে মেয়েদের পুরুষদের সঙ্গে বসা, কুচবিহার রাজপরিবারের সঙ্গে কেশবের নাবালিকা কন্যার বিবাহ ইত্যাদি নিয়ে প্রগতিপন্থী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী ও অন্যান্যদের সঙ্গে কেশবের মতভেদ বাড়তে থাকে। এমনকি এই মন্দিরের অধিকার নিয়ে তাঁদের বিরোধ থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল, যার বিবরণ আমরা পাই শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনীতে। পরে প্রগতিপন্থীরা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ নাম দিয়ে আলাদা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।


ঝামাপুকুরে কথামৃতকার শ্রী ‘ম’

শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৫৪-১৯৩২), যিনি ‘শ্রী ম’, ‘মণি’, ‘মাস্টার’, মোহিনীমোহন ইত্যাদি নানা ছদ্মনামের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রেখে অগণিত ভক্তবৃন্দকে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত পান করিয়েছেন তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ঝামাপুকুরের অদূরে ১৩/২ গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে হলেও তাঁর কর্ম ও ধর্মজীবনের একটা বড়ো অংশ কেটেছিল ঝামাপুকুর অঞ্চলেই।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঝামাপুকুরে অবস্থিত মর্টন স্কুলটি কিনে নেন এবং পরে ৫০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রীটে স্থানান্তরিত করেন।

৫০ নং আমহার্স্ট স্ট্রীটে শ্রী ‘ম’র স্কুল ভবন

তিনতলা এই বাড়িটির চিলেকোঠায় তিনি থাকতেন, এটিই ছিল তাঁর সাধন কুটীর, এবং এখানেই ও সংলগ্ন ছাদে চলত ভক্তদের সঙ্গে তাঁর ধর্মালোচনা। তাঁর অনুপ্রেরণায় অসংখ্য যুবক রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়েছেন। “ছেলেধরা মাস্টার” উপযুক্ত আধার দেখলেই ঠাকুরর জীবন ও বাণীর সঙ্গে তাঁদের নিবিড় পরিচয় করিয়ে দিয়ে পরে “মঠে” পাঠিয়ে দিতেন। ঐ চিলেকোঠার ঘরটি এক হিসেবে যেন হয়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ মিশনের শিশুশালা। বর্তমানে এই ভগ্নপ্রায় বাড়িটিতে রয়েছে হিন্দু একাডেমী নামে একটি স্কুল। স্থাপত্যের দিক থেকে এই বাড়িটির তেমন কোন মূল্য নেই, কিন্তু ঐতিহাসিক মূল্যের কারণে এটির সংরক্ষণ জরুরি।

হেমেন্দ্রমোহন বসুর বাড়ি

৫০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রীটের ঠিক উত্তরের বাড়িটিও বিখ্যাত। এটি কুন্তলীন তেল, তাম্বুলীন পানমশলা ও সুগন্ধি দিলখোস-এর স্রষ্টা এইচ বোস বা হেমেন্দ্র মোহন বসুর বাড়ি। হেমেন্দ্র মোহন বসু (১৮৬৪-১৯১৬) ছিলেন এক প্রতিভাধর এবং সফল বাঙালি ব্যবসায়ী।

স্বচ্ছল এবং বিখ্যাত পরিবারের ছেলে হেমেন্দ্রের ডাক্তার হওয়ার পথে বাধ সাধল ল্যাবোরেটরীতে এক দুর্ঘটনা। কিন্তু এই বাধার পরেই ব্যবসায়ে তাঁর প্রতিভার বিকাশ। সুগন্ধি থেকে সাইকেল, মোটর গাড়ি থেকে গ্রামোফোন রেকর্ড এসব ব্যবসাতে বাংলা তথা ভারতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ আবার এ দেশে প্রথম রঙিন ফটোগ্রাফিও তাঁর হাত ধরেই চালু হয়।

কুন্তলীন তেলের নামে সাহিত্য পুরষ্কার দেওয়া চালু করে তিনি পরোক্ষ ভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রসারেও অবদান রেখে গেছেন।
সিটি কলেজ – আনন্দমোহন বসু

আমহার্স্ট স্ট্রীট ধরে আর একটু উত্তরে গেলে বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট-আমহার্স্ট স্ট্রীটের সংযোগস্থলে রয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো কলকাতার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান – সিটি কলেজ। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ বহু প্রতিভাবান ছাত্র এবং প্রথিতযশা শিক্ষকের জন্য সঙ্গত কারণেই গর্ব বোধ করতে পারে।

সিটি কলেজ

যদিও কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, আসলে সিটি স্কুল ও কলেজ দু’য়েরই প্রাণপুরুষ ছিলেন আনন্দমোহন বসু (১৮৪৭-১৯০৬) । অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী আনন্দমোহন ছিলেন প্রথম ভারতীয় রাংল্যার, লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যারিস্টার, শিক্ষাব্রতী, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের (১৮৭৬) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং রাজনৈতিক নেতা।

ভারতের প্রথম সর্ব-ভারতীয় রাজনৈতিক সংঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আনন্দমোহন। এর আর এক কর্ণধার ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী । ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশন ছিল জাতীয় কংগ্রেসের পূর্বসুরী। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৯৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে আনন্দমোহন বসু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন ।

ঐতিহ্যমন্ডিত ঝামাপুকুরের ইতিহাস পরিক্রমা এখানেই শেষ হল। যে ঐতিহাসিক বাড়িগুলি এবং তাদের সঙ্গে জড়িত চরিত্রদের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরতে চেয়েছি তার বাইরেও অনেক কাহিনী অধরা রয়ে গেল। আশা করবো ভবিষ্যতে কোন অনুসন্ধিৎসু পাঠক সেগুলি নিয়ে আলোচনা করবেন ।

তথ্য সূত্রঃ-
• Raja Digambar Mitra, CSI – His Life and Career by Bholanath Chunder
• শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ – স্বামী সারদানন্দ
• শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী
• শ্রী রামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা – স্বামী গম্ভীরানন্দ
• শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত (অখন্ড সংস্করণ)
• এক সোনার মানুষ – স্বামী অব্জজানন্দ
• সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান
• শৃঙ্খল ঝঙ্কার – বীণা দাস
• Various websites

ছায়া চিত্রঃ শ্যামসুন্দরতলা – অভিজিত দে; ব্রাহ্মসমাজ মন্দির ও ৫০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রীট
(মর্টন স্কুল) – দীপাঞ্জনা মিত্র; ১৯১১র আই এফ এ জয়ী দল – পারিবারিক।
অন্যান্য – ইন্টারনেটের সৌজন্যে।