শিলাইদহের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় “ছিন্নপত্রাবলী”র মাধ্যমে। মনে পড়ে গ্রীষ্মের অলস দুপুরে বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরটায় বুকে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ছি

“কাছারির পরপারের নির্জন চরে বোট লাগিয়ে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।  দিনটা এবং চারিদিকটা এমনই সুন্দর ঠেকছে সে আর কী বলব। অনেক দিন পরে আবার এই বড়ো পৃথিবীটার সঙ্গে যেন দেখাসাক্ষাৎ হল।  সেও বললে ‘এই যে’। আমি বললুম ‘এই যে’। তার পরে দুজনে পাশাপাশি বসে আছি, আর কোনো কথাবার্তা নেই। জল ছলছল করছে এবং তার উপরে রোদদুর চিকচিক করছে; বালির চর ধূ ধূ করছে, তার উপর ছোটো ছোটো বন-ঝাউ উঠেছে।  জলের শব্দ, দুপুরবেলাকার নিস্তব্ধতার ঝাঁ ঝাঁ, এবং ঝাউ-ঝোপ থেকে দুটো-একটা পাখির চিকচিক শব্দ, সবসুদ্ধ মিলে খুব একটা স্বপ্নাবিষ্ট ভাব। …  

অথবা, কোন বর্ষার বৃষ্টিভেজা দিনে জানলা দিয়ে দেখছি সামনে সবুজ খেলার মাঠে স্থানে স্থানে জলজমে ঠিক যেন জলে ভরা ধান খেতের মতো লাগছে । আর পড়ছি কবির লেখা –  

“কাল সমস্ত রাত তীব্র বাতাস পথের কুকুরের মতো হূহু করে কেঁদেছিল — আর বৃষ্টিও অবিশ্রাম চলছে। মাঠের জল ছোটো ছোটো নির্ঝরের মতো নানা দিক থেকে কলকল করে নদীতে এসে পড়ছে – চাষারা ওপারের চর থেকে ধান কেটে আনবার জন্যে কেউ বা টোগা মাথায় কেউ বা এক খানা কচুপাতা মাথার উপর ধ’রে ভিজতে ভিজতে খেয়া নৌকোয় পার হচ্ছে – বড়ো বড়ো বোঝাই নৌকোর মাথার উপর মাঝি হাল ধ’রে বসে বসে ভিজছে – আর মাল্লারা গুণ কাঁধে করে ডাঙার উপর ভিজতে ভিজতে চলেছে”…

পরে শিলাইদহ এবং সেখানকার কুঠিবাড়ির ব্যাপারে বইয়ে পড়েছি।  কিন্তু কখনও শিলাইদহ যাওয়ার কথা মনে আসেনি।  একে তো পাকিস্তান (তখনও), তার উপরে পূর্ব বাংলায় আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন না। 

কিন্তু সেই পূর্ববঙ্গে যে আমায় যেতে হবে – তাও একবার নয়, দু’দুবার, “আছে সে ভাগ্যে লিখা” তখন সে কথা কে জানতো।  কিন্তু প্রথম বার, ইচ্ছে থাকলে্‌ও, নানা কারণে ঢাকা থেকে শিলাইদহ যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

সাতাশ বছর পরে আবার পোস্টিং হ’ল বাংলাদেশে। তবে এবারে ঢাকা নয়, রাজশাহীতে। আর সৌভাগ্যবশত কুষ্টিয়া – যে জেলায় শিলাইদহের অবস্থিতি – তা আমারই ‘এলাকায়’। রাস্তাও চমৎকার। কাজেই রবীন্দ্র বাউলের শিলাইদহ আর বাউল সম্রাট লালন ফকিরের ছেঁউড়িয়ায় যাওয়ায় কোনও বাধা ছিল না। তাই কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী সংগঠনের আমন্ত্রণ যখন এল,  সম্মতি দিতে দেরী করিনি।  

রাজশাহী থেকে কুষ্টিয়া গাড়িতে তিন ঘন্টার পথ।  আগে ফেরিতে পদ্মা পার হ’তে সময় লাগতো, কিন্তু এখন লালন শাহ সেতু হওয়ায় পথ অনেক সুগম। বিশাল পদ্মার উপর প্রায় পাশাপাশি দু’টো ব্রিজ –লালন শাহ সেতু ও রেলপথের বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। কলকাতা থেকে  রেলপথে পূর্ববঙ্গ ও আসাম যাওয়া সহজ করতে তখনকার ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১৯১২ সালে এটি চালু করে।     

১৯৭১এ পাকিস্তানী বাহিনীর উত্তরবঙ্গ থেকে যশোরে ফেরার পথ বন্ধ করতে আমাদের বিমান বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের একটি অংশ ধ্বংস করে। সেটি পরে নতুন করে তৈরি করা হয়। পদ্মার বুকে এই লাল রঙের সেতুটা দেখতে এত সুন্দর যে মনে হল গাড়ি থামিয়ে একটু দেখি, কিন্তু আমাদের দশটার মধ্যে কুষ্টিয়া পৌঁছতে হবে আর ‘এসকর্ট পার্টি’কেও আগে থেকে বলা হয়নি।    

সেতু পেরিয়েই ভেড়ামারা আর তার পরেই ছোটো, কিন্তু জনবহুল কুষ্টিয়া শহর । জেলার নামেই জেলার সদর। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সার্কিট হাউসে। এই সার্কিট হাউসগুলো ভারত বাংলাদেশ দু’জায়গাতেই একরকম। রক্ষণাবেক্ষণ খুব ভালো না হলেও এগুলোর অবস্থান শহরের সবচেয়ে ভালো নিরিবিলি জায়গায়। বাগান দিয়ে ঘেরা,  চমৎকার রান্না আর পরিপাটি ব্যবস্থা।  আবার, সরকারী কোন অনুষ্ঠান না থাকলে সার্কিট হাউস প্রায় ফাঁকাই থাকে।

ব্রেকফাস্টের পরেই আমার কিছু সৌজন্য সাক্ষাতকার ছিল জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য আধিকারিকদের সঙ্গে।  এছাড়া ছিল চেম্বার অফ কমার্সে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ও মধ্যাহ্ন ভোজন এবং সন্ধ্যায় কিছু মন্দির দেখা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, অধ্যাপক ও আরও অনেকের সঙ্গে সাক্ষাত ও পরিচয়।  দ্বিতীয় দিনের পুরোটাই জুড়ে ছিল কুঠিবাড়ি দেখা এবং লালন একাডেমির অনুষ্ঠান। 

কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউস থেকে কুঠিবাড়ি গাড়িতে আধ ঘন্টার পথ। কুঠিবাড়ি যে গ্রামে অবস্থিত তার পুরনো নাম ছিল খোরশেদপুর।  এখানে পদ্মা ও গোরাই নদী যেখানে মিলেছে তার কাছেই পদ্মাপাড়ে একটা প্রাচীন নীলকুঠি ছিল, যার মালিক ছিলেন শেলী নামে এক ইংরাজ কুঠিয়াল। আর দুই নদীর সঙ্গমস্থলে ছিল একটা বড় ‘দহ’ বা ঘূর্ণী। স্থানীয় মানুষেরা বলতেন শেলীর দহ, যা  কালক্রমে “শিলাইদহে” রূপান্তরিত হয়।      

দ্বারকানাথ ঠাকুর এখানকার জমিদারীর মালিক হন ১৮০৭ সালে। তখন পুরনো নীলকুঠিতেই ঠাকুর জমিদারদের কাছারি ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবনে শিলাইদহের সেই পুরনো কুঠিবাড়িতে  মাঝে মাঝে থেকেছেন। পরে পদ্মার ভাঙনে পুরনো বাড়িটা নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সেটি পরিত্যক্ত হয় এবং নতুন কুঠিবাড়ি তৈরি হয়।  পুরনো কুঠিবাড়ির এখন আর অস্তিত্ব নেই।

জমিদারীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে ১৮৮৯এর নভেম্বরে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে আসেন। ১৮৯১ থেকে ১৯০১এর মধ্যে  প্রায় দশ বছর কবি এখানে ছিলেন, তবে একটানা নয়।  এই সময়ের মধ্যে এখানে প্রায়ই এসেছেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, লোকেন পালিত এবং আরও অনেকে।  

“রবীন্দ্র পথের” শেষে ঢেউখেলানো পাঁচিলওয়ালা বাড়িটা দূর থেকে দেখেই মনের ভিতরে এক অন্যরকম অনুভূতি। চোখে পড়লো পাশের মাঠে বিশাল সামিয়ানার নীচে মানুষের ভিড়। কারণ জিজ্ঞাসা করে  আমি অবাক। “আজ তো রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন” বললেন স্থানীয় একজন। আমি তো জানতাম পরদিন পঁচিশে বৈশাখ। তখন একজন বললেন বাংলাদেশের বাংলা ক্যালেন্ডার ভারতের বাংলা ক্যালেন্ডারের থেকে একদিন এগিয়ে। ফলে পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানই ওদেশে একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়। 

দশ একরের কিছু বেশি জমির উপর তিনতলা বাংলো বাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর। এর পরিসরের মধ্যে রয়েছে দু’টি পুকুর সমেত আম কাঁঠালের বিশাল বাগান এবং ফুল বাগান। তিনতলা বাড়িটায় ছোটবড়ো পনেরোটা ঘর।   

লোহার গেট পেরিয়ে কুঠিবাড়িতে ঢুকলাম। বাড়ির গায়ের রঙ জায়গায় জায়গায় চটে গেছে। আমি যে ক’বার ওখানে গেছি এইরকমই দেখেছি। মনে হ’ল অতীতে কোনও সময়ে বাড়িটা লাল রঙের ছিল, পরে সাদা রং করা হয়। শুনেছি এখন নতুন ভাবে রং করা হয়েছে।   ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক যত্নের সঙ্গে ঘুরিয়ে দেখালেন। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে এক আকর্ষণীয় সংগ্রহশালা।  

প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি, তাঁর কবিতা, গান, গল্প ইত্যাদির পাণ্ডলিপির ফ্রেমে বাঁধানো ছবি আর তাঁর আঁকা ছবির কিছু ডিজিটাল প্রিন্ট। এছাড়াও রয়েছে কবি ও কবিপরিবারের ব্যবহৃত কিছু জিনিস, তাঁর প্রিয় পদ্মা বোটের প্রতিকৃতি, পালকি, ইত্যাদি। সন্দেহ নেই খুবই যত্ন এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিটি জিনিস সাজানো ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এরকম সংগ্রহশালা তো কলকাতা বা ঢাকাতেও বানানো যায়।

শিলাইদহের কুঠিবাড়ি তার সংগ্রহের বৈচিত্রে বিশেষ সমৃদ্ধ নয়। এর মাহাত্ম্য  অনুভবের বিষয়, দর্শনের নয়। কুঠিবাড়ির ঘর, বারান্দা, বাইরের বাগান সংলগ্ন পুকুর ঘাট, বকুলতলা এ সবই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বহন করে চলেছে। এখানেই কবি ও কবিপত্নী তাঁদের প্রথম স্বাধীন সংসার পেতে ছিলেন।  এখানেই পদ্মাতীরে এবং পদ্মাবক্ষে বোটে রচিত হয়ে ছিল বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ সোনার তরী,  চিত্রা, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য ও খেয়ার বেশিরভাগ কবিতা, অনেক নাটক, উপন্যাস এবং অজস্র গান। লিখে ছিলেন পল্লী জীবনের চিত্রসমৃদ্ধ অপূর্ব সব ছোটগল্প, আর “ছিন্নপত্রাবলী” যা শিলাইদহকে রবীন্দ্রানুরাগীদের কাছে অমর করে রেখেছে।  কবি নিজেই পত্রে লিখেছেন পদ্মাতীরের এই শিলাইদহ গ্রাম ছিল তাঁর যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য-সাধনার “তীর্থস্থান”।  

শিলাইদহে রবীন্দ্র প্রতিভা প্রধানত বিকশিত হয়েছিল পদ্মার নিত্য সাহচর্যে। সেই পদ্মাই যখন চলে গেল দূরে, তখন কবিও শিলাইদহ সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়লেন।  মাঝে মাঝে মনে পড়েছে। ভেবেছেন আবার সেখানে আসার কথা। কিন্তু হ’য়ে ওঠেনি।  দুঃখের সঙ্গে লিখেছেন পদ্মা শিলাইদহ থেকে দূরে সরে গেছে, আর তারই সঙ্গে কমে গেছে কবির সেখানকার প্রতি আকর্ষণ।  তা ছাড়া পরিণত বয়সে বোলপুরে বিশ্বভারতীর বিশাল কর্মকান্ড তাঁর মন এবং সময়ের বেশির ভাগটাই জুড়ে থাকায় ইচ্ছা থাকলেও শিলাইদহে আর তাঁর আসা হয়নি।   

দুর্ভাগ্য যে আমার সঙ্গে ছিল একগাদা লোক, ছবি তোলার দল আর সবার ওপরে নিরাপত্তা রক্ষীরা। আমার ‘স্বাচ্ছন্দের’ প্রতি তাদের অতিরিক্ত নজর আসলে আমাদের আর কুঠিবাড়ির আত্মার মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে ফেলেছিল। এরা কোলাহল তেমন করেনি। কিন্তু এরকম একদল মানুষের   উপস্থিতিই কোনও সুক্ষ্ম ভাবকে গভীর ভাবে উপভোগ করার একটা অন্তরায়। আমরা সবই দেখলাম। অতিথি-খাতায় মন্তব্য লিখলাম, এমনকি এক নাছোড়বান্দা টিভি সাংবাদিককে কিছু বলতেও হ’ল।

কিন্তু কবি যেমন সুদূর শান্তিনিকেতনে বসে  লিখেছেন 

“পদ্মা চলেছে কোথায় দূরে নীল আকাশের তলে

মনে মনে দেখি তাকে”

আমিও তেমনই কুঠিবাড়ি দেখার আনন্দ আস্বাদন করলাম মনে মনেই। কবি এবং তাঁর অন্তরঙ্গদের লেখার মাধ্যমে যে শিলাইদহের ছবি আমার মনে ছিল তা যদিও এই ট্যুরিস্ট স্পটের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলল না, আর কালের ব্যবধানে তা সম্ভবও নয়, তবু এখানে এই প্রথম এসে মন আনন্দে ভরে গেল। এরপরে যতবার শিলাইদহে গেছি, বা যেতে হয়েছে, ততবারই মনে হয়েছে কিছু যেন অদেখা রয়ে গেল ।   

শিলাইদহে আমার শেষ যাওয়া এক শীতের দিনে, ভারত থেকে আসা এক বিশিষ্ট সরকারি অতিথির সঙ্গে। ।  সেদিন কুঠিবাড়ির বকুলতলায় এক বৃদ্ধ আপন মনে রবিঠাকুরের গান গাইছিলেন।  আমরা ক’জন চুপকরে বসে অনেকক্ষণ শুনলাম। গানের সুর ছড়িয়ে পড়ছিল কুঠিবাড়ির শান্ত আঙিনায়।  গায়ক যেন রবীন্দ্রনাথের গান তাঁকেই নিবেদন করছিলেন।   বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পল্লীগায়কের গলায় “যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”… শুনতে শুনতে কিছুটা ভারাক্রান্ত মনে আমরা শিলাইদহ থেকে বিদায় নিলাম।