কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা বা অঞ্চলের নামের মধ্যে যে ইতিহাস লু কিয়ে রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বৈঠকখানা রোড, ফ্যান্সি লেন বা ছকু খানসামা লেন – এরকম অনেক রাস্তার নাম এই প্রসঙ্গে  মনে  আসে।  স্থানের বা  পাড়ার নামের  মধ্যে  বটতলা,  লেবুতলা,  পার্সী  বাগান  এসবনামকরণের কারণ সহজেই অনুমান করা যায়।

কিন্তু আবার কিছু নামের কোন অর্থ হয়না, বা প্রাচীন সার্থক নাম লোকমুখে বিকৃত হয়ে অর্থহীন হয়ে গেছে, কিন্তু সেই বিকৃত নামেই ঐ স্থানগুলো পরিচিত।

এইরকমই একটা বিকৃত নাম আজকের উল্টো ডাঙা । ডাঙা আবার উল্টো হয় কী করে! আসলে এর প্রাচীন এবং আসল নামটা আমাদের বাবা-জ্যাঠামশায়দের মুখে শুনেছি – “উল্টো ডিঙি” । এই নামটার অর্থ হয়, এবং এরকম নামকরণের কারণটাও সহজেই বোঝা যায়।

আজকের সল্ট লেকের পশ্চিম ধার দিয়ে যে “কেষ্টপুরের খাল” রয়েছে সেটা নজ্রুল ইসলাম অ্যাভিন্যুর মুখে এসে আটকে গেছে।  কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় – ভি আই পি রোড তৈরি হওয়ার আগে এই কেষ্টপুরের খাল উল্টো ডাঙার খালের সঙ্গে জোড়া ছিল।  অর্থাৎ এটা একটাই খাল ছিল যা বাগবাজারের কাছে গঙ্গায় গিয়ে মিশতো। 

কেষ্টপুর-উল্টোডাঙা-বাগবাজারের খালে বিশাল বিশাল নৌকো চলতে আমরা দেখেছি, যে নৌকোগুলো সুন্দরবন থেকে মাতলা ও বিদ্যাধরী নদী এবং তার পরে পূর্বকলকাতার বিশাল জলাভূমির মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া বাগজোলা ও  কেষ্টপুরের খাল বেয়ে বাগবাজার হয়ে গঙ্গায় চলে যেত।  সুন্দরবন থেকে কলকাতা  আসার এটা ছিল সহজ জলপথ। 

যাহোক, কোন এক সময়ে আজকের উল্টো ডাঙার কাছে খালে সম্ভবতঃ একটা ডিঙি নৌকো উলটে যায়, যেটা সে সময়ে নিশ্চয় একটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে ছিল।  আর সেই থেকেই জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছিল “উল্টো ডিঙি”। আবার এরকমও হতে পারে  যে খালের বাঁকে প্রায়ই ডিঙি উলটে যেত, যা থেকে জায়গাটার নাম হয়ে যায় উল্টো ডিঙি।  তারপরে কীভাবে “ডিঙি” ডাঙায় রূপান্তরিত হয়ে গেল, সেটা হয়তো ভাষা তাত্ত্বিকরা বলতে পারবেন।  

উল্টো ডাঙার কথায় মনে পড়ে গেল পুরনো কলকাতার আর একটা জায়গার এইধরণের একটা নাম ছিল। আজ সেই জায়াগাটিকে সে নামে কেউ চিনবে না – কলকাতার ইতিহাসের পাতায় ছাড়া আর কোথাও তাকে পাওয়া যাবেনা। জায়গাটার নাম – ডিঙা ভাঙা ।

এ নাম খুব একটা চেনা মনে হচ্ছে না তো? কিন্তু যদি বলি “ক্রীক রো” তাহলে বোধহয় অনেকেই বলবেন হ্যাঁ, চিনি তো। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের (আজকের সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার) পূর্ব দিক থেকে সার্কুলার রোড (আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রীট) পর্যন্ত চলে যাওয়া এই রাস্তাটির আশপাশের অঞ্চলটারই এককালে নাম ছিল ডিঙা ভাঙা।

কিন্তু এরকম নাম কেন? উল্টো ডাঙার খাল তো আজও রয়েছে, তাই ওখানকার নাম “উল্টো  ডিঙি” বলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ক্রীক রোর নাম ডিঙা ভাঙা ? আজ থেকে পৌনে তিনশ’ বছর আগে কিন্তু এই নামেই লোকে জানত কলকাতার এই অঞ্চলটাকে। অবশ্য একটা সূত্র বলছে এই অঞ্চলকে আগে “কলিঙ্গ জলা” (Colinga Jala) বলা হত। আজকের তালতলা (সেকালে, “তালপুকুর” এই “কলিঙ্গ জলা”র মধ্যেই পড়ত।

ক্রীক রো নামের মধ্যেই ডিঙা ভাঙা নামের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। আসলে প্রাচীন কলকাতার এই অঞ্চলটা দিয়ে বয়ে যেত একটা ছোট নদী বা ক্রীক। খাল নয়। হুগলী নদী থেকে বেরিয়ে পূব-মুখো এই ছোট শাখা নদীটি এঁকেবেঁকে  চলে গিয়েছিল ধাপা হয়ে সুন্দরবনের দিকে। রীতিমতো নৌকো চলত এই পথে। নদীর চলতি নাম কি ছিল জানিনা, কিন্তু তখনকার ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, একে “ক্রীক” বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে।  

চোখ বুজে একবার ভেবে নেওয়া যাক, সেই তিনশ’ বছর আগে ধানের ক্ষেত আর জলার মধ্যদিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী একেবারে শহরের (তখন তো গ্রাম) বুক চিরে দু’পাশের সবুজ গাছের ছায়া পড়েছে তার নিস্তরঙ্গ জলে। দাঁড় টেনে ভেসে যাচ্ছে একটা দু’টো নৌকো।  

ইতিহাস বলছে ১৭৩৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর কলকাতার উপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রচন্ড ঘূর্ণী ঝড়। সেই ঝড়ে গোবিন্দ মিত্রের নবরত্ন মন্দিরের চূড়া ভেঙে পড়েছিল। সেই সময়ের এক বিলিতি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী,  ঝড়ের দাপটে অন্ততঃ দুটি পাঁচশ’ টনের জাহাজ হুগলি নদী থেকে উড়ে নিকটস্থ গ্রামে গিয়ে পড়ে এবং টুকরো টুকরো হয়ে যায়।   তিরিশ হাজার (কোন কোন মতে তিন লক্ষ) লোকের মৃত্যু হয় ।  ভাঙা পড়েছিল অসংখ্য জাহাজ, নৌকো, ইত্যাদি। কাঁচা বাড়ির তো কথাই নেই, সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল অনেক পাকা বাড়িও। মাত্র ছ’ ঘন্টায় পনেরো ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছিল । হুগলি নদীর জল বেড়ে গিয়েছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট।  

তা সেই ঝড়ে বেশ কিছু “ডিঙা” বা নৌকো এই ক্রীকের পাড়ে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই। ব্যস, জায়গাটার নাম হয়ে গেল “ডিঙা ভাঙা” । কালে নদীটা মজে গেল। সেই মজা নদীর বুকের উপর দিয়ে তৈরি হল চলাচলের পথ। ধীরে ধীরে “ডিঙা ভাঙা” হারিয়ে গেল মানুষের স্মৃতি থেকে।

কিন্তু সব তো হারিয়ে যায় না। শহরের ইংরাজ কর্তারা মনে রেখেছিলেন নদীটার কথা, আর তাই নতুন এই পথের নাম দিলেন “ক্রীক রো”। যে পথে আমরা ছোটবেলায় আমহার্ষ্ট স্ট্রীট থেকে হেঁটে ময়দানে খেলা দেখতে যেতাম আর আজও হাজার হাজার মানুষ হেঁটে যায় কত কাজে।

কেই বা মনে রেখেছে সেই “ডিঙা ভাঙা” আর তার  সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সেই ছোট নদীটাকে।

A Map of around 1680, showing The Creek

ক্রীক রো এই পথের নামের মধ্যেই ডিঙা ভাঙা নামের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। আসলে প্রাচীন কলকাতার এই অঞ্চলটা দিয়ে বয়ে যেত একটা ছোট নদী। খাল নয়। হুগলী নদী থেকে বেরিয়ে পূব-মুখো এই ছোট শাখা নদীটি ওয়েলিংটন স্কোয়ার হয়ে, আজকের ক্রীক রোর মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছিল ধাপা হয়ে সুন্দরবনের দিকে। রীতিমতো নৌকো চলত এই পথে। নদীর চলতি নাম কি ছিল জানিনা, কিন্তু তখনকার ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, একে “ক্রীক” বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে।  

আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন শহর কলকাতা গড়ে ওঠেনি, কেবল গোড়া পত্তন হয়েছে। চারিদিকে জলা, ঘন জঙ্গল আর ধান ক্ষেত।

চোখ বুজে একবার ভেবে নিন সেই তিনশ’ বছর আগে ধানের ক্ষেত আর জলার মধ্যদিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী একেবারে শহরের (তখন তো গ্রাম) বুক দিয়ে। দু’পাশের সবুজ গাছের ছায়া পড়েছে তার নিস্তরঙ্গ জলে। দাঁড় টেনে ভেসে যাচ্ছে একটা দু’টো নৌকো।

পুরনো কলকাতার ইতিহাস বলছে ১৭৩৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর কলকাতার উপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রচন্ড ঘূর্ণী ঝড়। সেই ঝড়ে গোবিন্দ মিত্রের নবরত্ন মন্দিরের চূড়া ভেঙে পড়েছিল। সেই সময়ের এক বিলিতি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী,  ঝড়ের দাপটে অন্ততঃ দুটি পাঁচশ’ টনের জাহাজ হুগলি নদী থেকে উড়ে নিকটস্থ গ্রামে গিয়ে পড়ে এবং টুকরো টুকরো হয়ে যায়।   তিরিশ হাজার (কোন কোন মতে তিন লক্ষ) লোকের মৃত্যু হয়, ভাঙা পড়েছিল অসংখ্য জাহাজ, নৌকো, ইত্যাদি। কাঁচা বাড়ির তো কথাই নেই, সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল অনেক পাকা বাড়িও। মাত্র ছ’ ঘন্টায় পনেরো ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছিল । হুগলি নদীর জল বেড়ে গিয়েছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট।  

তা, সেই ঝড়ে বেশ কিছু “ডিঙি” বা “ডিঙা” এই ক্রীকের পাড়ে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই। ব্যস, জায়গাটার নাম হয়ে গেল “ডিঙা ভাঙা” । কালে নদীটা মজে গেল। সেই মজা নদীর বুকের উপর দিয়ে তৈরি হল চলাচলের পথ। ধীরে ধীরে “ডিঙা ভাঙা” হারিয়ে গেল কালের গর্ভে ।

কিন্তু সব হারিয়ে যায় না। শহরের ইংরাজ কর্তারা মনে রেখেছিলেন নদীটার কথা, আর তাই নতুন এই পথের নাম দিলেন “ক্রীক রো”, যে পথে আমরা ছোটবেলায় আমহার্ষ্ট স্ট্রীট থেকে হেঁটে ময়দানে খেলা দেখতে যেতাম আর আজও হাজার হাজার মানুষ হেঁটে যায় কত কাজে। কিন্ত ক্রীক শব্দটা যে এক হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষ্য সে কথা ক’ জনেরই বা মনে জাগে?

হয়তো ভবিষ্যতে কোন পৌরপিতা কোনও বিখ্যাত চরিত্রের নামে এই পথের নামকরণ করবেন, আর চিরকালের মতো আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে ডিঙা ভাঙা আর সেই নামহীন ছোট নদীটার গল্প।