গানের ব্যাকরণ আমি জানিনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান যে বাণী ও সুরের সার্থক যুগলবন্দী সেটা আমার অশিক্ষিত কানেও দিব্যি বুঝতে পারি । আর যে গায়ক পরিবেশনের গুণে শ্রোতার মনে অনুরণন তুলতে পারেন, অল্পক্ষণের জন্য হলেও তাকে প্রাত্যহিক তুচ্ছতা থেকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন, তাঁরই পরিবেশন সার্থক।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুবিনয় রায় এরকমই এক সার্থক শিল্পী । তাঁর কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রথম শুনি আকাশবাণীতে। আর পরে গ্রামোফোনে লংপ্লেয়িং রেকর্ডে । তথাকথিত “জনপ্রিয়তার” বৃত্তের বাইরে সুবিনয় রায় ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অসাধারণ রূপকার। কোন আসরে তাঁর একক পরিবেশন শোনার এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমার একবারই হয়ে ছিল । সেও কলকাতায় নয়।
সেটা বোধহয় ১৯৭৯ সাল, আমার দিল্লি প্রবাসের দ্বিতীয় বছর। দিল্লির স্টেটসম্যান কাগজটার কাটতি যদিও ওঁদের কলকাতার কাগজের তুলনায় ছিল অনেক কম, বাঙালিরা – বিশেষ করে আমরা যারা সদ্য কলকাতা থেকে রাজধানীতে গেছি – তারা নেহাতই অভ্যেসের বশে ইংরিজি কাগজের মধ্যে ওটিই পছন্দ করতাম। তার একটা কারণ অবশ্যই ছিল এই যে কলকাতার অনেক খবর থাকত ওই কাগজে।
সেই স্টেটসম্যানে একদিন একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম – “রবীন্দ্রসঙ্গীতানুরাগীরা স্বাগত। … দিন সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টায় AIFACS (All India Fine Arts and Crafts Society) হলে বিখ্যাত শিল্পী সুবিনয় রায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করবেন। অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকার অফিস থেকে সংগ্রহ করা যাবে”।
এ সুযোগ ছাড়া যায়না। দুটো কার্ড যোগাড় হল। আমার “মেসের” বন্ধু মুক্তিপদ মিশ্রকে কষ্টে রাজি করালাম সঙ্গ দেবার জন্য। সে মানকরের ছেলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত তার পছন্দ নয় তত।
আইফ্যাক্স আমার পরিচিত জায়গা। দিল্লির ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিটা তখন ওই বাড়িতে ছিল। আমার অফিস থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। যথাসময়ে হলে পৌছলাম এবং বেশ ভাল সিটও পাওয়া গেল। হল ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভরে গেল। এদিকে “মুক্তি” উস্খুস করছে – আর আমি ওকে শান্ত করছি।
ঠিক সময়ে সুবিনয় রায় এলেন। যতদূর মনে আছে, উনি হারমোনিয়ম ব্যবহার করেছিলেন এবং তবলাবাদক ছাড়াও তানপুরা ইত্যাদি নিয়ে দু’তিনজন সঙ্গত করছিলেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে শিল্পীর পরিচয় এবং মালা দেওয়ার পরে অনুষ্ঠান শুরু।
তাঁর প্রথম গান “আজি এ আনন্দ সন্ধ্যা…” দিয়ে সুবিনয় রায় আসরের সুরটা একটা উঁচু মাত্রায় বেঁধে দিলেন। তারপর সুরের এক অপরূপ ফল্গুধারায় আমরা ভেসে গেলাম। পিন ড্রপ সাইলেন্স কাকে বলে সেদিন আমি বুঝেছিলাম। পাশে আমার বন্ধু একেবারে আক্ষরিক অর্থে হাঁ করে গানে মশগুল। সবচেয়ে ভাল লেগেছিল যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে – একেকটা গানের পরে হল নিস্তব্ধ, কোনও করতালি ছিল না। সবাই যেন গানগুলিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলেন।
দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠান। মাঝে দশ মিনিট বিরতি এবং তার পর আবার সেই সুরের ঝর্নাধারায় স্নান। শেষ গান – “গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে …” গেয়ে শিল্পী যখন শ্রোতাদের নমস্কার করলেন তখন যেন সেই সমাবেশ আবার এই মাটির ধরাতলে ফিরে এল, আর পাক্কা দশ মিনিট ধরে চলল হাততালি দিয়ে অভিনন্দন। একটা ঘোরের মধ্যে আমরা হল ছাড়লাম।
ফেরার পথে বাসে বন্ধুকে জিগ্যেস করলাম, “কেমন লাগল?”। ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, “কী আর বলব, এমন গান আগে কখনও শুনিনি।”
আগামীকাল, ৮ই নভেম্বর সুবিনয় রায়ের জন্মদিনে প্রয়াত শিল্পীকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
…….
৭ই নভেম্বর ২০২১