বন ও বন্যপ্রাণী যাঁরা ভালবাসেন , রাজস্থানের রণথম্ভোর জাতীয় উদ্যান তাঁদের কাছে খুবই পরিচিত।  এই পরিচিতির কারণ  এখানে নাকি সহজেই বাঘের দেখা মেলে।  এটা সাধারণ ভাবে সত্যি হলেও সবসময় যে বাঘ দেখা যাবেই তা নয়। বাঘ ছাড়াও এখানে দেখতে পাওয়া যায় কুমীর, নীলগাই, সম্বর, চিতল হরিণ এবং কখনও কখনও স্লথ ভালুক ও হায়েনা ।  এছাড়াও এখানে আছে ব্ল্যাক স্টর্ক সহ কয়েক ধরণের সারস, হাঁস ও অন্যান্য প্রজাতির পাখি। ময়ূর আর হনুমানের কথা তো ছেড়েই দিলাম।   

রণথম্ভোরের বনপথ

রণথম্ভোরের সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন সওয়াই মাধোপুর।  দিল্লি থেকে ভোরের ট্রেনে উঠে বেলা এগারোটা নাগাদ সেখানে নেমে আধ ঘন্টার মধ্যে আমাদের হোটেলে পৌঁছে গেলাম।  দুপুরের সাফারি অনলাইনে বুক করা ছিল।  বেলা আড়াইটেয় আমাদের হোটেল থেকে “ক্যান্টারে” উঠে বিভিন্ন হোটেল থেকে অন্যান্য পর্যটকদের তুলে  কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকে পড়লাম রণথম্ভোরের জঙ্গলে।

এবারের যাত্রায় আমরা বহু চেষ্টা করেও জিপসি পেলামনা বন দেখার জন্য। ক্যান্টার একটা খোলা ট্রাকের মতো – কুড়িজন বসতে পারে। আমার সন্দেহ ছিল এত বড় একটা গাড়ির আওয়াজে কোন জন্তু জানোয়ার দেখা দেবে কি না। আমার সে সন্দেহ কিন্তু অমূলক প্রমাণিত হয়েছিল। এখানকার বন্যপ্রাণী জিপসি ও ক্যান্টার দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু দেখলাম মানুষের গলার আওয়াজ তারা পছন্দ করেনা । তাই জন্তু জানোয়ার দেখতে গেলে চুপ করে থাকতে হবে।  

সে কোন বনের হরিণ…

রণথম্ভোরের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আয়তন প্রায় চারশ বর্গ কিলোমিটার, যদিও পুরো জাতীয় উদ্যানটির আয়তন এর দ্বিগুণেরও বেশি। পর্যটনের জন্য এর অতি সামান্য অংশই খোলা আছে, এবং তাও দশটি জোনে ভাগ করা। প্রথম পাঁচটা জোনেই নাকি বাঘের দর্শন মেলে; অন্যগুলোতে তাঁর যাওয়া আসা কম। আমাদের দুপুরের সাফারি ছিল এক নম্বর জোনে।  গাইড প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, “বাঘ দেখতে পাওয়া ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।  আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখব না, কিন্তু আপনারা বাঘ ছাড়াও অন্য অনেক প্রাণী দেখতে পাবেন। বনের সৌন্দর্য উপভোগ করুন”। 

জলের ধারে ঘুমিয়ে কুমীর

সত্যিই আমাদের ভাগ্যে রয়্যাল বেঙ্গলের দর্শন ছিলনা এদিন। তাই তিন ঘন্টা বিস্তর ঘোরাঘুরি করেও সেই দুপুরে আমদের বা অন্যান্য ক্যান্টার বা জিপসিতে যাঁরা ছিলেন ঐ জোনে, কারোরই ব্যাঘ্র-দর্শন  হয়নি।  মনের দুঃখ চেপে হরিণ, সম্বর, নীলগাই, হনুমান আর পাখির ছবি তুলে গেলাম। 

স্ত্রী সম্বর
পুরুষ সম্বর

পাশদিয়ে কোন ক্যান্টার বা জিপসি গেলেই আমরা প্রশ্ন করছিলাম, “দেখেছেন নাকি?”। আমাদের রসিক গাইড বলল, “মুখ দেখে বুঝতে পারছেন না, এরা সব ভোটে হারা পার্টি!” মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে গাইড শোনার চেষ্টা করছিল কোন হরিণ, হনুমান বা ময়ূরের সাবধান-বার্তা, যা বড় শেয়ালের উপস্থিতির নিশ্চিত প্রমাণ। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল করে তিনি প্রচ্ছন্নই রইলেন।

সাফারির সময় শেষ হওয়ার পরে যখন আমরা বন থেকে বেরিয়ে আসছি তখন জানা গেল চার নম্বর জোনে দুটো বাঘ একটা সম্বর মেরেছে, এবং বহু পর্যটক তাদের দেখার বিরল সুযোগ পেয়েছে।  আমরা ভগ্ন মনোরথ হয়েই হোটেলে ফিরলাম। সান্ত্বনা এই যে পরদিন ভোরের সাফারি বাকি আছে, এবং সেটা হবে দু নম্বর জোনে। কাজেই মোবাইলে ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল ছ’টায় বের হতে হবে। 

লাল ঠোঁট ও পা-ওয়ালা ব্ল্যাক স্টর্ক
অত্যন্ত মিশুকে ট্রি পাই

শীতের সকাল ছটায় একটু অন্ধকার। ঠিক সময়ে আমাদের দ্বিতীয় সাফারি শুরু হল।  ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটল আর বনের বাসিন্দারা তাদের প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে দেখলাম ।  এবার গাইড বদলে গেছে, সহযাত্রীরাও নতুন। তাঁরা তো একটা ময়ূর বা কিছু চিতল হরিণ দেখলেই বলছেন “গাড়ি থামাও” আর ফটাফট সেলফি তুলছেন, ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করার জন্য।  গাইডবাবাজিও  থেকে থেকেই হেঁকে  উঠছেন, “পীকক, স্পটটেড ডীয়ার, মঙ্কি” বলে, আর ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছে সেলফি বাহিনীকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। 

গাইডের এরকম করার কারণ ছিল। কোন কোন লেট লতিফ যাত্রীকে তোলার জন্য আমাদের ক্যান্টাররের অনেক সময় নষ্ট হয়। অন্য কিছু যাত্রী তাই নিয়ে গাইডের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে কিছ্ অম্ল-মিশ্রিত মধুর বাক্য প্রয়োগ করেন। তাতেই তাঁর মেজাজ যায় বিগড়ে আর সে জন্যই আমাদের উপর এই প্রতিশোধ!     

আমি এদিকে ক্যামেরায় টেলিফোটো লাগিয়ে বসে আছি, কখন তেনার লেজের ডগা দেখতে পাবো, আর এঁরা দেখছেন “স্পটটেড” হরিণ যা দেখতে এতদূরে আসার মানেই হয় না।  শেষ পর্যন্ত আমি উঠে গিয়ে গাইডকে ফিসফিস করে বললাম যে ময়ূর আর হরিণ অনেক দেখেছি, আর রাগ না করে সে যেন আমাদের ‘আসল জিনিস’ দেখানোর চেষ্টা করে।  তার প্রশ্ন, “কুছ বোনাস মিলেগা?” হ্যাঁ বলা ছাড়া উপায় ছিলনা ।  কিন্তু কোথায় বাঘ!

আমাদের এবং অন্যান্য গাড়ি গুলোও হন্যে হয়ে সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় – বিশেষ করে জলাগুলোর আশে পাশে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ফেরার পথ ধরল। আমরাও হতাশ হয়ে চুপ করে বসে।  এমনি সময় হঠাৎ শোনা গেল হনুমানের “কল” আর ময়ূরের সাবধানী ডাক।  বোঝা গেল কাছাকাছি কোথাও বাঘের চলা ফেরা শুরু হয়েছে। আরও কয়েকটা জিপসি ও ক্যান্টার আমাদের আশপাশে দাঁড়িয়ে গেল। সবাই চুপ করে করে দুদিকের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে। একটা হরিণ দেখি ঘাস খাওয়া বন্ধ করে কান খাড়া করে আমাদের কনভয়ের দিকে তাকিয়ে। 

বাঘের খোঁজে হন্যে হয়ে…
অবশেষে মহারাজের দর্শন

যে পথ দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম তার বাঁ দিকে একটু খোলা ঘাসের জমি যেখানে ভয়-পাওয়া হরিণটা দাঁড়িয়ে ছিল, আর ডান পাশে কিছু গাছপালা, আর তারপরেই একটা অগভীর পাহাড়ি ঝর্ণা বয়ে চলেছে।  আমাদের ড্রাইভার ও গাইড প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, “ডাহিনে দেখিয়ে”।  আমি বসেছিলাম ডান দিকেই।  গাছের ফাঁক দিয়ে দেখি মাত্র কয়েক হাত দূরে বিশাল এক রয়্যাল বেঙ্গল জলের উপর পেট ডুবিয়ে বসে চক চক করে জল খাচ্ছে আর চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। এত কাছ থেকে বাঘ আমি জিম কর্বেট পার্কেও দেখিনি। হলুদের উপর কালো ডোরা, বিশাল চেহারা আর অদ্ভুত সুন্দর সবুজ-হলুদ চোখ। আফ্রিকায় সিংহ দেখেছি। বিশাল এবং ভয়ানক চেহারা। কিন্তু এই রয়্যাল বেঙ্গলের মতো দেহ-সৌষ্ঠব তার নেই। আমার মতে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারই বনের  আসল রাজা।       

জলপানরত রয়্যাল বেঙ্গল
গাছের ফাঁক দিয়ে

এরপর আমি আর ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ সরাইনি। ড্রাইভার গাড়িটা একটু সামনে পিছনে করে আমাদের দেখার সুযোগ করে দিচ্ছিল আর আমি শাটার টিপে চলেছিলাম। কী উঠছে – আদৌ উঠছে কিনা – এসব ভাবার সময় ছিলনা।  বোধহয় মিনিট সাতেক পরে বাঘটা উঠে দাঁড়াল এবং ধীরে ধীরে রাস্তার দিকে চলে গেল। পরে জেনেছিলাম বনবিভাগের খাতায় এঁর নাম টি-১০১।  

বনের আসল রাজা

ফেরার পথে আমাদের মুখে সত্যিই শক্ত পরীক্ষায় পাস করার আনন্দ। অন্য গাড়ির যাত্রীরা বাঘ দেখেছি কী না জিজ্ঞাসা করলেই সমস্বরে সবাই বলছিলাম, “হ্যাঁ, দেখেছি”। হোটেলে নামাবার সময় গাইড কিন্তু “বোনাস”-এর কথাটা মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি।     

 বন ও বন্যপ্রাণী ছাড়াও দেশের মধ্যে রণথম্ভোরই সম্ভবত একমাত্র জাতীয় উদ্যান যার মধ্যে রয়েছে এক বিশাল দুর্গ।ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সাতশ ফুট উঁচু প্রায় ২ বর্গমাইলের এই কেল্লাটির অনেক অংশেরই  এখন ভগ্ন দশা।  কিন্তু এর বিশাল বিশাল সাতটি “পোল” বা দরজা, কয়েকটা হাভেলি, স্তম্ভ  ও গম্বুজ  এবং সীমানার জবরদস্ত প্রাকার  এর গৌরবময় অতীত ও বহু যুদ্ধবিগ্রহের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকদের মনে সম্ভ্রম জাগায়। দুর্গের উপর থেকে রণথম্ভোর টাইগার রিজার্ভের দৃশ্য অপূর্ব।  এই দুর্গটি ২০১৩ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে।   

আয়তনে চিতোরগড় বা কুম্ভলগড়ের তুলনায় ছোট হলেও রণথম্ভরোরের কেল্লা তার দীর্ঘ জীবনে অনেক উত্থান-পতন দেখেছে।  সম্ভবতঃ ৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দে চৌহান রাজবংশের হাতে এর গোড়া পত্তন। একসময় এই কেল্লা ছিল দিল্লির পৃথ্বীরাজ চৌহানের অধীন। তার পরে বিভিন্ন সময়ে এই কেল্লা কখনও দিল্লির সুলতানদের হাতে গেছে আবার কখনও কোন চৌহান রাজা একে পুনরুদ্ধার করেছেন। 

এঁদের মধ্যে একাধারে অসামান্য বীর এবং শিল্পের গুণগ্রাহী ছিলেন রাজা হামীরদেব। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিনের এক বিদ্রোহী সেনাপতিকে তিনি আশ্রয় দেন এবং আলাউদ্দিনের হাতে তাঁকে তুলে দিতে অস্বীকার করেন। আলাউদ্দিন রণথম্ভোর আক্রমণ করেন ১২৯৯ সালে, কিন্তু তাঁর দুই সেনাপতি হামীরদেবের কাছে পরাজিত হন।

এবার আলাউদ্দিন স্বয়ং রণথম্ভোর আক্রমণ করেন।  দীর্ঘ অবরোধের ফলে দুর্গে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। হামীরদেব এবং তাঁর অনুগত সেনাবাহিনী সুলতানী সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ দেন আর রাজ-অন্তঃপুরের নারীরা জহর ব্রত অনুষ্ঠান করেন। অবশেষে ১৩০১ সালে আলাউদ্দিন রণথম্ভোর দখল করতে সমর্থ হন। রণথম্ভোরের গাইডরা আজও হামীরদেবের বীরত্বের নানা প্রচলিত কাহিনী শুনিয়ে পর্যটকদের মনোরঞ্জন করেন।    

মেবার ও বুন্দির রাণাদের এবং মুঘল সম্রাট আকবরের হাত ঘুরে অবশেষে রণথম্ভোর জয়পুরের অধিকারে আসে ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে, এবং ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জয়পুর তথা  রণথম্ভোর রাজস্থান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

দুর্গের একটা বিরাট অংশে এখন সারানোর কাজ চলছে। পুরনো রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি রয়েছে ঐ অংশেই। দুর্গের শীর্ষে রয়েছে একটি গণেশ মন্দির, রাজা হামীরদেবের পূজিত শিবলিঙ্গ, জৈন মন্দির এবং সাম্প্রতিক কালে কোন এক “সিদ্ধ” সন্ন্যাসীর প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির।  

দুর্গে ওঠার পথে দেখার মতো হচ্ছে সাতটি “পোল” বা গেট।  বিরাট বিরাট কাঠের কপাট ওয়ালা এবং তীক্ষ্ণ গজাল লাগানো এই পোলগুলো দেখলে বোঝা যায় কেন আক্রমণকারীরা সহজে এই কেল্লা দখল করতে পারেনি।  প্রতিটি পোলের পাশেই রয়েছে বিশাল মোটা গম্বুজ, যার ফোকর দিয়ে পথের উপর নজর রাখা বা শত্রুর উপর আক্রমণ চালানো হত।  সুন্দর সুন্দর কয়েকটি ছত্রি আর বত্রিশ স্তম্ভের একটা স্থাপত্য আজও অটুট। 

এই কেল্লা এখন আর্কিওলজিকাল সার্ভের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু একে ভালভাবে সংরক্ষণ করার তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়লনা।  একটা ফলকে অতি সংক্ষেপে দুর্গের ইতিহাস হিন্দিতে লেখা রয়েছে । যাঁরা হিন্দি জানেননা  কিন্তু এই দুর্গটিকে ভাল্ভাবে দেখতে চান তাঁদের কিছুটা হতাশই হতে হবে ইংরাজিতে এর ইতিহাস না লেখা থাকায়।