প্রায় তিন যুগ পরে এসপ্ল্যানেড-লিন্ডসে স্ট্রীট-নিউ মার্কেট-পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে গিয়েছিলাম। মাত্র কয়েক ঘন্টার এই ঝাঁকিদর্শনে তেমন কিছুই দেখা হয় না জানি। তবুও এই এক পলকে একটু দেখাই বা কম কী?

পাকাপাকি কলকাতা ছেড়ে ছিলাম আশির দশকে। মাঝে মাঝে ছুটিতে এসে বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতাম। হয়ত দুএকবার ওই অঞ্চলের কোন রেস্তরাঁয় খেতে গেছি, কিন্তু সে ট্যাক্সিতে যাওয়া আসা, এবং সন্ধ্যেবেলা। পায়ে হেঁটে না দেখলে কোন জায়গাই ঠিকমত দেখা হয়না বলে আমার বিশ্বাস।   

তাই এসপ্ল্যানেড মেট্রো থেকে পার্ক স্ট্রীট ভায়া লিন্ডসে স্ট্রীট-নিউ মার্কেট পায়ে পায়ে যেতে যেতে আমার দেখা চৌরঙ্গীর সঙ্গে আজকের জওহারলাল নেহরু রোডকে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। মনে আছে ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে এক বাঁ পাঁচ নম্বর ট্রামে চেপে এসপ্ল্যানেড যাওয়ার কথা। তখন পুরো ধর্মতলা স্ট্রীটে, একমাত্র চাঁদনীচকের মোড়ে ফলের দোকানগুলো ছাড়া ফুটপাথে খুব বেশি দোকান দেখেছি বলে মনে পড়েনা। আর চৌরঙ্গীর ফুটপাথ তো প্রায় উল্টোদিকের “গড়ের মাঠ”-এর মতই ফাঁকা।  হ্যাঁ, আজকের ময়দানকে আমরা গড়ের মাঠই বলতাম।  

অনেক দিন আমরা এসপ্ল্যানেডে ট্রাম বদল করে বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম চলে যেতাম। ফেরার সময় সন্ধ্যে হয়ে যেত। তখন ধীরে ধীরে চৌরঙ্গী রোডের বিশাল চওড়া ফুটপাথ ধরে ধর্মতলায় এসে ট্রাম ধরতাম। পার্ক স্ট্রীট না আসা পর্যন্ত ফুটপাথ  প্রায় জনহীন।  পথ কম নয়, কিন্তু তখন খুব একটা দূর মনে হত না।

পার্ক স্ট্রীট থেকে ধর্মতলার মোড় পর্যন্ত রাস্তাটা কিন্তু বেশ গমগম করত। বড়বড় দোকানের কাচের মধ্যদিয়ে দেখা যেত কত রকমের জিনিস আর খরিদ্দারদের ব্যস্ততা। গ্র্যান্ড হোটেলের দরজায় পাগড়ীপরা, কোমরবন্ধ-আঁটা মস্ত গোঁফওয়ালা  দরোয়ানকে কোন মহারাজার চেয়ে কম মনে হত না।  মাথা তুলে তাকালে কত বিজ্ঞাপণ।  লিপটনের চায়ের বিজ্ঞাপণটা (সম্ভবত চৌরঙ্গী-ধর্মতলার মুখটাতে) ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়।  একটা কেটলি থেকে কাপে চা ঢালা হচ্ছে, যেটা আলোর কারসাজিতে অপূর্ব লাগত।   

এমনকি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়েও – সেও প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলল  – বন্ধু দেবরঞ্জনের সঙ্গে বিড়লা প্ল্যানেটরিয়মে একটা “পপুলার অ্যাস্ট্রোনমি” ক্ল্যাস করতে যেতাম সন্ধ্যে বেলা। তখনও চৌরঙ্গীর ফুটপাথ মোটামুটি ফাঁকাই থাকত।  

আজ এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়েই মনে হল কোন মন্ত্রবলে হাতিবাগানের হকার্স মার্কেটটা চৌরঙ্গীর ফুটপাথে এসে হাজির হয়েছে। সেই দু’পাশে প্ল্যাস্টিকের ছাউনি দেওয়া জতুগৃহ; মাঝখানে এক চিলতে সুঁড়িপথ। জওহরলাল নেহরু রোড থেকে তো দূরের কথা, ফুটপাথে দাঁড়িয়েও বড় বড় দোকানগুলোকে দেখা দুঃসাধ্য। একজন দেখিয়ে না দিলে বাটার দোকানটাকে প্রায় মিস করে ফেলেছিলাম।   

লিন্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে যে গার্ডেন ভ্যারেলির দোকান থেকে কয়েকবার গিন্নিকে শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম ছুটিতে এসে, সে দোকানটা আজও রয়েছে। কিন্তু মনে হল শাড়ি আর ওদের প্রধান পণ্য নয়। নানারকম কাপড়জামা শাড়িগুলোকে কোনঠাসা করে ফেলেছে। মনে হয় ঐ বিশেষ ধরণের শাড়ি এখন আর জনপ্রিয় নয়।      

পুরনো নিউ মার্কেটটা তার আগের  ঔজ্জ্বল্য এবং অবশ্যই আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে ।  হগ সাহেবের সেই লাল রঙের চমৎকার বাড়িটা তেমনই দাঁড়িয়ে আছে।  ভিতরের দোকানগুলোও, কিছু বদল সত্ত্বেও, রয়েছে আগের মতই। কিন্তু মার্কেটের বাইরে যে চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর হট্টগোল, তাতে নেহাত আমার মতো কিছু নস্ট্যালজিয়াগ্রস্ত মানুষ আর ট্যুরিস্ট (যাঁদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বলে আমার মনে হল) ছাড়া বাকি কলকাতার ক্রেতারা নিউ মার্কেটে কতটা  কেনাকাটা করতে  আসেন আমার জানা নেই।  তাঁদের সম্ভবতঃ বেশি দেখা যায় শহরের আলো ঝলমল ‘মল’ গুলোতে।   

কিন্তু বনেদি, অভিজাত ক্রেতাদের মতোই এখানকার সাবেকী দোকানগুলোর পুরনো চাল খুব সামান্যই বদলেছে। দেখলাম তাদের মালিকদের অনেকেরই আধুনিক এল ই ডি ল্যাম্পের চেয়ে দু’পাশ কালো হয়ে যাওয়া চারফুটের টিউব লাইটই বেশি পছন্দের। ফলে যথেষ্ট ভাল ভাল জিনিসপত্র থাকলেও, অনেক আধুনিক ক্রেতা এসব দোকানে ঢোকেন না। যাঁরা এখানকার খানদানি খরিদ্দার তাঁদের কথা আলাদা।    

সাবেক নিউমার্কেট আংশিক পুড়ে যাওয়ার পরে যে নতুন নিউমার্কেট তৈরি হয়েছে তার চেহারা দেখে আর ঢুকতে ইচ্ছে করল না। এই নির্মাণশৈলি যে কার মাথা থেকে বেরিয়েছে কে জানে।   এই গরমের দেশে এরকম অপ্রশস্ত বাজার!  একটা আগুন লাগলে বেরোবার রাস্তা নেই!  এর চেয়ে পুরনো নিউ মার্কেট অনেক সুন্দর।    

লিন্ডসে স্ট্রীট আর নিউ মার্কেটের পরে আমাদের গন্তব্য ছিল পার্ক স্ট্রীটের অক্সফোর্ড বুক স্টোর। এখন যার নামের আগে অ্যাপিজে কথাটা যোগ হয়েছে। যেতে যেতে দেখলাম দয়ালু হকাররা গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে কয়েক গজ, আর যাদুঘরের সামনে কয়েক হাত ফুটপাথকে রেয়াত করেছেন। জাদুঘরের সামনে দর্শনার্থীর ভিড় দেখে কিন্তু ভাল লাগল। যাক, এখনও কেউ কেউ তাঁদের ছেলে মেয়েদের এই “মরা চিড়িয়াখানা” দেখাতে নিয়ে আসেন!   

পার্ক স্ট্রীট তার ঐতিহ্য কিছুটা ধরে রেখেছে। তার প্রধান কারণ এই রাস্তায় হকার না থাকা এবং যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পারাপার  বন্ধ করে দেওয়া। তবে কে বলবে আজ থেকে মাত্র শ’তিনেক বছর আগে এই পার্ক স্ট্রীটের নাম ছিল বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড, আর এখানকার বিখ্যাত কবরখানা এবং তার দক্ষিন দিকে ছিল গভীর জঙ্গল, যেখানে অন্ধকার নামলেই শোনা যেত বাঘের গর্জন। আজ কলকাতা বাড়তে বাড়তে প্রায় সুন্দরবনের দরজায় পৌঁছে গেছে,  আর তখন সুন্দরবন ছিল সেই সদ্যোজাত কলকাতা শহরের দোরগোড়ায়!   

 অক্সফোর্ড বুক স্টোরে ঢুকে মনটা ভাল হয়ে গেল। যে বইগুলোর জন্যে এতটা আসা সেগুলো সহজেই পেয়ে গেলাম। ওগুলো ঘরে বসেও সংগ্রহ করা যেতনা তা নয়। এমনকি অক্সফোর্ডও ক্রেতাদের সে সুবিধা দিচ্ছেন শুনলাম। কিন্তু নিজের হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে – দু’এক পাতা পড়ে নিয়ে – বই কেনার মজাই আলাদা । তাছাড়া যখন এক সহৃদয় কর্মচারী এই বরিষ্ঠ নাগরিককে একটা বসার টুল এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করলেন, তখন বই ঘাঁটার সুযোগ না নেওয়াটা কি বোকামি হত না?     

এই লেখা কেউ পড়বেন তেমন দুরাশা আমার নেই। তবু যদি কারো তির্যক দৃষ্টি পড়ে, তিনি হয়ত ভাববেন ভর দুপুরে এত ঘুরে ঘুরে – তাও পার্ক স্ট্রীটের মতো খানদানি খাওয়ার জায়গায় – লেখকের কি খিদে পায় নি? কই ওখানকার অত রকমারি এবং ছোটবড় নানা রেস্তোরাঁর কথা তো কিছু এতে নেই। আসলে আমরা এদিন ঠিক করে ছিলাম স্ট্রীট ফুড খাবো। তাই রেস্তোরাঁগুলোকে এড়িয়ে যা আমরা খেয়েছিলাম তা উহ্যই থাক। ডাক্তারবাবুরা যাই বলুন, রসনা তৃপ্তিতে কলকাতার পথ-খাদ্য অদ্বিতীয়। আর ওই খাবার খেয়ে – নেহাতই দুর্ভাগ্য না হলে – কারো প্রাণান্ত হয়েছে বলে জানা নেই।       

পার্ক স্ট্রীট থেকে পাতাল পথে বাড়ি ফিরলাম। কলকাতা মেট্রো অবশেষে তার সেই লোকাল ট্রেনের বগিগু লোকে একটু রদবদল করে মাটির নীচে দিয়ে চালানো বন্ধ করেছে। এবার দিব্যি ঠান্ডা কামরায় আরামে সফর করা গেল। উপরে হাজার হাজার গাড়ি আর দম বন্ধ করা যান-জট, আর আমরা মাত্র পনেরো কুড়ি মিনিটেই পৌঁছে গেলাম দক্ষিন থেকে উত্তরে!   ভাবতে ভাল লাগছিল, আমাদের এই শহরেই ভারতের প্রথম মেট্রো চলেছিল, আর কিছুদিনের মধ্যেই গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রো চালিয়ে আবার কলকাতা একটা নজির রাখতে চলেছে।         

চৌরঙ্গীর, এবং শহরের আরও বহু জায়গার  ফুটপাথ জবরদখল হয়ে গেছে। কোন অলৌকিক হস্তক্ষেপ  ছাড়া তাদের আর ফিরে পাওয়া যাবেনা। শহরের জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে তাতে এখনও যে কোন কোন রাস্তায় ফুটপাথ নামক ডাইনোসরটিকে দেখা যায় সেটাই আশ্চর্য।   

এই তিন চার ঘন্টায় চৌরঙ্গী ও তার আশপাশের অনেক জায়গায় যাওয়া হল না। দেখা হলনা ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের পুরনো বইয়ের বা ধর্মতলার পুরনো রেকর্ডের  দোকান গুলো বা শীল লেনের সেই শতবর্ষ-প্রাচীন কয়েকটা দোকান, পুরনো ক্যামেরা সারাতে যাদের জুড়ি ছিলনা।   

কিন্তু যা দেখলাম তাতেই প্রচুর আনন্দ পেলাম। উত্তর কলকাতা অবশ্যই ঐতিহ্য-মন্ডিত। কিন্তু মধ্য কলকাতা্র ধর্মতলা-চৌরঙ্গী অঞ্চলের প্রাচীনত্ব কিছু কম নয়। উপরন্তু এখানে নতুন আর পুরনোর সহাবস্থান একটা দর্শনীয় ব্যাপার। কালের ধর্মে ছোটবেলার চৌরঙ্গী হারিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু আজকের  চৌরঙ্গীও তার ঝলমলে বহিরঙ্গ আর ক্ষয়িষ্ণু অন্দরমহল নিয়ে আগের মতই আকর্ষণীয়। 

ছবিঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে