টোটো চলেছে চওড়া পীচঢালা রাস্তা দিয়ে। চালাচ্ছে অর্জুন। ও আমাদের জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। দু’দিকে ঘন শালবন। কোথাও বা বনভূমি পাতলা হয়ে ধানের ক্ষেতে শেষ হয়েছে, লাল মাটির রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের ঘরবাড়ির মধ্যদিয়ে। মন উদাস করা ছবি। কিছুটা গিয়ে আবার জঙ্গল শুরু। গাছের ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ্দুর পথের উপর আলোছায়ার আলপনা কেটেছে। এক এক জায়গায় হাতির ছবি দিয়ে লেখা “এলিফ্যান্ট ক্রশিং, ড্রাইভ স্লো।“

অরণ্য-কুহেলির পথে
আমাদের কুটির

এমনি করে মাইল দশেক আসার পর আমাদের টোটো ডান দিকে বাঁক নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। লাল কাঁকড়ের রাস্তা, দুপাশে ঘন গাছে ঘেরা কয়েকটা বাংলো বাড়ি। জনমানব চোখে পড়ল না। কিছুটা এগিয়ে একটা খোলা গেটদিয়ে ঢুকে আমাদের গাড়ি একটা বিস্কুট রঙের পুরনো বাংলোর সামনে দাঁড়াল। এরই নাম অরণ্য-কুহেলী – আমাদের হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম।

আমরা নামতেই আমরা যার অতিথি সেই সঙ্গীতা হাসিমুখে এগিয়ে এল। পুরনো বাংলোটা থেকে কয়েক মিটার দূরে আর একটা নতুন বাংলো – বিশাল বিশাল আম কাঁঠাল বেল তেঁতুল আর নিম গাছের নীচে। এরই একটা ঘরে আমাদের আশ্রয় জুটলো – ঘরের নাম “আম।” চারিদিক নিস্তব্ধ, হাওয়ায় গাছের পাতার শব্দ ও পাখীর ডাক ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। অল্প দূরে আর একটা বাংলো তৈরি হচ্ছে দেখতে পাই। ব্যাগটা ঘরে রেখে বাংলোর সামনে রাখা চেয়ারে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম চা এসে পড়ে।

শীত যাব যাব করছে, কিন্তু যায়নি; আবার বসন্তও পুরোপুরি আসেনি এমনই একটা সময়ে আমাদের এই জঙ্গল সফর। কলকাতার গোলমাল থেকে দূরে কোন নিরিবিলি জায়গায় দু-তিন দিন কাটিয়ে আসার ইচ্ছে, কিন্তু যাই কোথায়? দীঘা? সেখানে সবসময় ভিড় লেগে আছে। পুরুলিয়ার মুকুটমণিপুরের খুব নামডাক ট্যুরিস্ট মহলে। থাকার ব্যবস্থাও বেশ ভাল। কিন্তু ইউটিউবে ওখানকার সন্ধ্যে বেলার আলোকসজ্জা দেখে ভাল লাগল না। অবশেষে এই লোধাশুলির জঙ্গল ঘেঁষা ঝাড়গ্রামে আসা।

ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে খবর নিই এই বাংলোটার ব্যাপারে, আর জেনে নিই আশপাশে কোথায় যাওয়া যেতে পারে। বাংলোটা প্রথমে ছিল এক সাহেবের। তারপর হাতবদল হয়ে বর্তমান মালিক সোমনাথ চৌধুরীর কাছে। চারপাশে প্রায় ষোল একর জমিতে শাল, কেঁদ, আম কাঁঠাল তেঁতুল ইত্যাদি ছাড়াও রয়েছে অজস্র কাজুবাদামের গাছ এবং আরও নানারকমের গাছপালা যা এই অঞ্চলের জঙ্গলে সাধারণত জন্মায়। বাংলোগুলোর সামনের সামান্য কিছু অংশ বাদ দিয়ে বাকি জায়গাটাকে জঙ্গলই বলা চলে। জমিটার চারদিকে নামমাত্র পাঁচিল ও বেড়া দেওয়া আছে, কিন্তু গেট সবসময় খোলা, এবং হাতির জন্য অবারিত দ্বার। গেটের ঠিক বাইরে রাঙামাটির সরু রাস্তা জঙ্গলের মধ্যদিয়ে চলে গেছে কোন দূর গাঁয়ের দিকে। এবং সেটি, পরে শুনলাম, হাতির যাওয়া আসার পথও বটে।

আমাদের বাংলোর আশপাশ

ব্রেকফাস্ট সেরে অর্জুনের টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খুব কাছেই একটা ভেষজ উদ্যান দেখতে। বেশ বড় জায়গা নিয়ে এই উদ্যানে বিভিন্ন জানা-অজানা বনৌষধির চাষ করা হয়েছে। ছোট ছোট বোর্ডে তাদের প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক নাম, কি ধরণের রোগ নিরাময় করে ইত্যাদি লেখা রয়েছে। ভেষজ বিদ্যার ছাত্রদের কাছে এই উদ্যান খুবই আকর্ষণীয় হবে। সাধারণ দর্শকও এখান থেকে অনেক কিছু জানতে পারবেন। বেশ খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে আমাদের অতিথিশালায় ফিরে এলাম।

তখনও দুপুরের খাওয়ার অনেক দেরি। তাই একপ্রস্ত চা খেতে খেতে এই সম্পত্তির মালিকের সঙ্গে কথা হল। সোমনাথবাবু সেই সত্তরের দশকে কলকাতার পাট চুকিয়ে এই অঞ্চলে বাস করতে শুরু করেন। তারপর থেকে সপরিবারে এখানেই আছেন। হোমস্টের কাজকর্ম ওঁর মেয়েই দেখেন এবং একই সঙ্গে কলকাতায় নিজের পরিবারকেও। কয়েক বছর আগে এখানে মাওবাদীদের খুব দাপট ছিল। এখন অবশ্য সে গোলমাল আর নেই। কিন্তু যেটা আছে তা কম ভয়ঙ্কর নয় – বন্য হাতির উৎপাত। জানা গেল, একটু গরম পড়লেই তাদের আনাগোনা শুরু হবে, আর আম পাকলে তো কথাই নেই।

দুপুরের খাওয়া একদম ঘরোয়া রান্নার ডাল তরকারি মাছের ঝোল আর চাটনি। শেষ পাতে দই। ঝাড়গ্রাম শহর আর তার কাছেই কনকদুর্গা মন্দির ও অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান দেখার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম দুপুরের খাওয়ার পরেই। প্রথমে গেলাম কনকদুর্গা মন্দিরে। ১৯ কিলোমিটার রাস্তা, কিন্তু জায়গায় জায়গায় মেরামতের কাজের জন্য লেগে গেল ৪৫ মিনিট।

কনক দুর্গা মন্দিরঃ বাঁ পাশে নতুন মন্দির; উপরেঃ পুরাতন মন্দির, সারানোর পর

কনকদুর্গা মন্দিরটা প্রাচীন। কোনকোন মতে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। স্থানীয় রাজা গোপীনাথ এটির নির্মান করেছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু বর্তমান মন্দিরটি সাম্প্রতিক কালের তৈরি। পুরনো মন্দিরটা পাশেই ছিল, কিন্তু সেই ভগ্নপ্রায়, প্রায় মাঝামাঝি ফেটে যাওয়া মন্দিরটির স্থানেও একটি নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। কনকদুর্গা নাম শুনে মনে হয় আসল মূর্তিটি ছিল সোনার। তবে এখনকার মূর্তিটি অষ্টধাতুর।

মন্দিরের অবস্থানটা খুব সুন্দর – চিল্কিগড় জঙ্গলের মধ্যে। এখন সেখানে একটি জীব–বৈচিত্র্য উদ্যান। মন্দিরের চত্বরটা বেশ বড়। একধারের কয়েকটি দোকান যেখানে পূজার সামগ্রী পাওয়া যায়। মন্দিরের পাশদিয়ে জঙ্গলের পথে একটু নীচে নামলেই পাহাড়ি নদী ডুলুং বয়ে চলেছে। ডুলুং সুবর্ণরেখা নদীতে গিয়ে মিশেছে। নদীতে এখন জল খুব কম, কিন্তু শুনলাম বর্ষার ডুলুং দুর্গামন্দিরের একদম পাশদিয়ে বয়। বড় বড় পাথরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ডুলুঙের ধারটা খুব সুন্দর। একটু পরেই সূর্যাস্ত হবে – সে সময় এর দৃশ্য অপূর্ব হবে, সন্দেহ নেই। ফেরার পথে কিছুক্ষণের জন্য ঝাড়গ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়া হল। মিশনের মাঠে স্কুলের ছেলেরা খেলাধূলা করছে।ঝাড়গ্রাম শহরে পৌঁছলাম যখন তখন প্রায় সন্ধ্যে। তাই আদিবাসী সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি দেখা হল না। তবে রাজবাড়িটা গেট থেকে দেখলাম। আমাদের মতো ভ্রমণকারীদের জন্য প্রবেশ নিষেধ।

আমাদের অরণ্যাবাসে ফিরে এলাম যখন তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাংলোগুলোয় আলো জ্বলছে, চারদিকে ঘোর অন্ধকার। গা ছমছমে একটা পরিবেশ। বারান্দায় বসে চা খাওয়া গেল। মশার উপদ্রব খুব, কিন্তু ঘরে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা থাকায় কোন অসুবিধে হয় নি। একটু পরে গরম তেলেভাজা আর মুড়ি এল। আমরা সাধারাণত সন্ধ্যেবেলা শুধু চা-ই খাই, কিন্তু এই পরিবেশে বেগুনি-ফুলুরি দিয়ে মুড়ি খেতে বেশ লাগল।

বাইরে এসে অন্ধকার জঙ্গল দেখছি, আর শুনছি নানারকম পোকার আওয়াজ। দূর থেকে একটা গম্ভীর বিউগেলের মতো আওয়াজ শুনলাম। আমার মনে হল হাতির ডাক। সীমা যথারীতি একমত হল না। গেটটা অনেকটা দূরে – সেখানে কোন আলো নেই। এখানকার আকাশ তারায় ভরে থাকার কথা। কিন্তু দেখলাম মেঘে ঢাকা আকাশে তাদের চিহ্নমাত্র নেই। ঝড়ের পূর্বাভাস আছে। খানিক্ষণ বারান্দায় বসে কিন্ডল খুলে বই পড়ার বৃথা চেষ্টা করলাম। খালি মনে হচ্ছে এই বুঝি দেখব জঙ্গলের মধ্যদিয়ে হাতি আসছে। গৃহস্বামীর দুই দেশী কুকুর নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সঙ্গীতা বলে ছিল যে কুকুররা অনেক আগে থেকেই হাতির উপস্থিতি টের পায়। ওদের এড়িয়ে হাতি আসতে পারবে না। ভাবি, ওদের ঘুম ঠিক সময় ভাঙলে হয়! দুটি সারমেয়র ভরসায় এরকম একটা জায়গায় থাকতে হলে বেশ সাহস দরকার।

রুটি, তরকারি আর মুরগীর কারি দিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করে বারান্দাতেই একটু পায়চারি করে এবং তারপর হাতির কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। সীমার ডাকাডাকিতে উঠে পড়লাম। টিনের চালের উপরে চড়বড় করে কীসব পড়ার শব্দ। জানালা দিয়ে দেখি, বাইরে জোর হাওয়া চলছে। সীমাতো ধরেই নিয়ে ছিল হাতি এসে বোধহয় ভাঙচুর করছে। কিন্তু হাতি চালের উপর উঠবে কী করে? তবে কি শিলাবৃষ্টি হচ্ছে? নাঃ তাও নয়। কিছু পরে বোঝা গেল আসলে ঝড়ে গাছ থেকে পাকা তেঁতুল ও শুকনো ডাল পড়ছে টিনের চালে! শব্দটা তারই।

ভোরে ঘুম ভাঙতেই বাইরে গিয়ে দেখি অজস্র তেঁতুল পড়ে আছে চারিদিকে। কিছু কুড়নো গেল। আজ আমাদের বেলপাহাড়ি কাঁকড়াঝোড়, ইত্যাদি ঘোরার কথা। দশটায় বেরিয়ে সারাদিন ঘোরা। তাই ব্রেকফাস্টের আগে জঙ্গলে কিছুটা হেঁটে এলাম, আর শুনলাম এক স্থানীয় কাজের মেয়ে বলছে যে তার গ্রাম থেকে লোধাশুলির জঙ্গলের মধ্যদিয়ে এখানে আসার সময় সে তিনটে হাতি দেখেছে। ব্রেকফাস্টের সময় সঙ্গীতা আমাদের জানাল যে কথাটা সত্যি, কারণ স্থানীয় মানুষদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও খবরটা এসেছে। তবে, ও আশ্বস্ত করল যে একটু বেলায় হাতিরা জঙ্গলের বাইরে বার হয় না। আমাদের গাড়ি এসে গেল দশটার আগেই, আর প্যাক করা লাঞ্চ ও জলের বোতল নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বেলপাহাড়ির পথে।

বেলপাহাড়ীর পথে
রাজপথ ছেড়ে রাঙামাটির রাস্তায়

আমাদের হোমস্টেটা ঝাড়গ্রাম থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে। এবার যাচ্ছি তার উল্টো দিকে। স্কুলের সময়, তার উপর মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। ফলে ঝাড়গ্রামের সংকীর্ণ রাস্তাগুলোয় একেবারে শিয়ালদা স্টেশনের ভিড়। তাই এক ঘন্টার রাস্তা আসতে লাগল প্রায় দু ঘন্টা। আমাদের ড্রাইভার বৈদ্যনাথ জানালো প্রথমে আমরা যাব ঢাংঙ্গিকুসুম বলে একটা জায়গায়। সেখানে একটা পাহাড়ি নদী বড়বড় পাথরের মধ্যদিয়ে বইছে। ছোট একটা জলপ্রপাতও রয়েছে। কিন্তু এখন বৃষ্টি নেই, নদীতে জল নেই। কাজেই জলপ্রপাত নয়, কুলকুল করে একটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে। আমাদের মতো কয়েকজন “ডাই হার্ড” পর্যটক ছাড়া আর লোকজন বিশেষ নেই। সংখ্যায় কম হলেও ওই ক’জনই চিৎকার চেঁচামিচি করে জায়গাটা সরগরম করে তুলেছেন। আর রয়েছে কয়েকটা ছোট ছোট দোকান – স্থানীয় মানুষেরা পাথরের থালা বাটি গ্লাস ইত্যাদির পসরা নিয়ে বসেছেন।এবার গন্তব্য গড়রাসিনি পাহাড়। এদিকের রাস্তাটা বেশ সরু, আর দুপাশে জঙ্গল ও ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে আদিবাসী গ্রাম। গ্রামগুলো খুবই পরিচ্ছন্ন, বাড়িগুলো ঘেঁষাঘেঁষি নয়। অনেক বাড়িরই গায়ে সুন্দর ছবি আঁকা, অথবা দু’রকম রঙ করা। গড়রাসিনি পাহাড়ের ঠিক নিচে “সত্যানন্দ আশ্রম।“ ইচ্ছে ছিল আশ্রমের ভিতরটা দেখার, কিন্তু দরজা খোলা ছিল না।

পাহাড়টা খুব উঁচু নয়। উপরে ওঠার রাস্তাটাও চওড়া। তবে একটা লাঠি থাকলে ভাল হতো। শালবনের মধ্যদিয়ে পথ – ঝরে পড়া শালপাতায় ঢাকা। একটু ওঠার পর পাথুরে রাস্তা শুরু। কঠিন কিছু নয়, কিন্তু আলগা, ছোটছোট পাথরগুলোয় দু’একবার পা হড়কে গেল। এই পাহাড়ে দু’টো মন্দির আছে। প্রথম মন্দিরটা পর্যন্ত উঠলাম। বিষ্ণু মন্দির। ছোট্ট, কিন্তু সুন্দর। নিচের সত্যানন্দ আশ্রম এটির দেখাশোনা করে। পরের মন্দিরটা আরও কিছুটা উপরে, আর পথ বলতে কিছু নেই। বড়বড় পাথরের মধ্যদিয়ে এঁকেবেঁকে উঠতে হবে। উপর থেকে দু’জন লোক নেমে এলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল যে নিচে থেকে যতটা এসেছি তার অর্ধেক উঠলেই পাহাড়ের মাথা। কিন্তু কুয়াশার মতো হাল্কা মেঘ থাকায় নিচের দৃশ্য দেখা যাবে না। মন্দিরের চাতালে গাছের ছায়ায় বসে রইলাম। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। সবই ভাল, কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের জলের বোতল, আলুভাজার প্যাকেট, আরও অনেক আবর্জনা। বোঝাই যাচ্ছে আমাদেরই মতো কিছু নির্বোধ পর্যটক এই কাজটি করে গেছেন।

গড় রাসিনির পথে

পাহাড় থেকে নেমে এসে বেশ খিদে পেয়ে গেছে। একটি ছেলে কচি শশা বিক্রি করছে। আমাদের সঙ্গে ছিল ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন। একটা খালি দোকান ঘরে বাঁশের বেঞ্চ আর বাঁশের টেবিলে শালপাতার প্লেটে শশার স্যালাদ দিয়ে চমৎকার লাঞ্চ হয়ে গেল। বৈদ্যনাথকেও খাওয়ালাম। গড়রাসিনি জায়গাটা সত্যিই খুব শান্ত আর সুন্দর।
লাঞ্চের পরে আমরা চললাম খ্যাঁদারানি লেক দেখতে। কাকরাঝোড়ের শালবনের ভিতর দিয়ে মেঠো পথ। আমরা তো জঙ্গল দেখতেই এসেছি, তাই আলোছায়ায় মোড়া রাস্তায় এই ড্রাইভটা বেশ উপভোগ করলাম। খ্যাঁদারানি লেক আসলে একটা খালের উপর বাঁধ দিয়ে জলসেচের জন্য তৈরি একটা জলাধার। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে লেকের দৃশ্য মনোরম। এটা এখানকার একটা জনপ্রিয় বনভোজনের জায়গা। আমাদের গাড়ি চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু সে এই লেকের নাম খ্যাঁদারানি কেন হল তা বলতে পারল না।

খ্যাঁদারানি লেক

এরপর গেলাম ঘাগরা “জলপ্রপাত” দেখতে। তারাফেণী নদী এখানে একটা মোটামুটি গভীর খাতের মধ্যদিয়ে বইছে আর এক জায়গায় এই জলধারা একটু নিচে উপছে পড়ছে। এই সময় নদীতে জল নেই, তাই জলপ্রপাত দেখার সৌভাগ্য হল না। কিন্তু গিরিখাতের মধ্যদিয়ে বয়েচলা এই শীর্ণ নদী যে বর্ষাকালে অপরূপা হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। এখান থেকে অল্প দূরত্বে তারাফেণী নদীর বাঁধ। কিন্তু আমাদের ফিরতে হবে সন্ধ্যের আগেই। তাই বৈদ্যনাথকে বলি গাড়ি ঘোরাতে। পাঁচটার একটু আগেই ফিরে এলাম আমাদের কুটীরে।

চা খেয়ে, আর কোন কাজ না থাকায় আমরা প্রথমে আমাদের বাংলোর সীমানাটা পুরো ঘুরে দেখলাম। আর তারপরে চুপচাপ গেটের বাইরে যে মেঠো পথটা চলে গেছে সেইটা ধরে অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে হাঁটতে লাগলাম। তখন পুরোপুরি সন্ধ্যে হয়নি, কিন্তু বনে আঁধার নামতে শুরু করেছে। সামনে পিছনে কোন জনমানব নেই, শুধু পাখীর ডাক আর আমাদের পায়ের শব্দ। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই সীমা বলতে শুরু করল ‘এখন যদি হাতি এসে পড়ে, কী করবে?’ আমি চারিদিকে চেয়ে হাতির কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না বটে, কিন্তু ওই প্রশ্নের কোন গ্রহণযোগ্য উত্তরও আমার কাছে ছিল না। কারণ আমাদের দু’দিকে দুয়েকটা পোড়ো বাংলো আর তার সঙ্গে জঙ্গল। সেখানে হাতির হাত থেকে বাঁচার মতো কোন জায়গা চোখে পড়ল না।

হাতির আসাযাওয়ার পথ

তাই বললাম, ‘হাতি এলে আমি রাস্তা ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকব চুপ করে’। দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি বা প্রধান মন্ত্রীর কনভয় গেলে পুলিশ যেমন সাধারণ পথচলতি মানুষকে রাস্তার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে, সেই কথা মনে পড়ে ছিল বোধহয়। এই উত্তর কারোরই পছন্দ হবার নয়, সীমারও হল না। সে বলল ‘আমি তো দৌড় লাগাব’। আমার জোড়াতাপ্পি মারা হাঁটু নিয়ে দৌড়তে গেলে হাতির পায়ের তলায় পড়ে নয়, এমনিতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তাই বললাম, ‘হাতি কিন্তু বেশ জোরে দৌড়তে পারে’। এই সব বলতে বলতে আমরা ফিরলাম – আর দূরে যাওয়ার সাহস ছিল না। ইতিমধ্যে আমাদের পাশের দুটো ঘর “তেঁতুল” ও “কাঁঠাল”-এ একটি পরিবার উঠেছে। ওঁদের সঙ্গে আলাপ হল। ওঁরা এখানে আগেও এসেছেন। এবারে আসার প্রধান উদ্দেশ্য কনকদুর্গা মন্দিরে পুজো দেওয়া।

আজ সঙ্গীতা সারাদিন তার মায়ের চোখ অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিল ঝাড়গ্রাম শহরে। তাই একজন স্থানীয় মানুষ – অরুণ মাহাতো, আমাদের জলযোগের ব্যবস্থা করল। পরে সঙ্গীতা ফিরলে যখন আমাদের সান্ধ্যভ্রমণের কথা বললাম, ও বলল বাংলোর বাইরের ওই রাস্তাটায় খুব ভোরে আর সন্ধ্যের মুখে কেউ হাঁটে না হাতির ভয়ে। এমনকি গাঁয়ের মানুষজনও একটু ঘুরপথে যায়। তার উপর আজ আবার হাতির দল আশেপাশেই রয়েছে। কাজেই আমরা যে হাতির ভয় করেছিলাম সেটা একেবারে অমূলক ছিল না। ভাবলাম, আজ রাতে নিশ্চয় হাতি আসবে। সঙ্গীতার কাছ থেকে একটা বই চেয়ে নিয়ে বারান্দায় বসে পড়ার চেষ্টা করছি, আর কুকুর দুটোর দিকে তাকাচ্ছি। তারা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। জানি, ওরা আমাদের আগেই বুঝতে পারবে কোন বিপদের কথা, কিন্তু বইয়ে কী মন বসে!

রাতে খাওয়ার সময় সঙ্গীতা আমাদের শোনালো হাতি নিয়ে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা। হাতি বাগানে (যদিও আসলে প্রায় জঙ্গল) ঢুকলে ওরা কি করে জিগ্যেস করায় বলল ওরা তখন চুপচাপ ঘরের মধ্যে থাকে আর উঁকি দিয়ে দেখে হাতি কোথায়, কি করছে। আর, রান্না করা বন্ধ রাখে, কারণ হাতি ভাত-রুটির গন্ধ পেলে বিপদ। একবার সঙ্গীতার মা দরজায় ঠক ঠক শব্দ করায় একটা হাতি বাংলোর ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু উপরের টিনের চালটা নিচু হওয়ায় সফল হয় নি। আর একবার ও আর অরুণ মাহাতো হাতির খুব সামনে পড়ে গিয়েছিল। সে যাত্রা ওরা দৌড়ে প্রাণ বাঁচায়।

এ ছাড়া জানলাম এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাতিটার স্থানীয় নাম “রামলাল।“ সে অনেকবার এই বাগানে ঢুকেছে আম কাঁঠাল খেতে। তার নানা কীর্তির মধ্যে একটা হচ্ছে কোন খাদ্যদ্রব্য, ফল ইত্যাদির লরি গেলে তাকে আটকে রীতিমতো লুট করা! কিন্তু সে বাস বা ছোট গাড়িকে কিছু বলে না। তবে একবার অরুণ রামলালকে বেশি বিরক্ত করায় সে তার সামান্য রাগ দেখিয়েছিল যে ঘরে আমরা আছি তার সামনের কাঠের রেলিংটাকে অল্প একটা টোকা দিয়ে ভেঙে দিয়ে। আবার, গরমকালে হাতিরা প্রায়ই বাগানে ঢুকে এদিকে ওদিকে রাখা বড় বড় জল রাখার পাত্র থেকে জল নিয়ে খায় ও শুঁড়ে করে গায়ে ছেটায়। শুনলাম যে বেসিনের কলে আমরা একটু পরেই হাত ধোব, জল খাবার জন্য কয়েক বারই সেটা হাতিতে ভেঙে দিয়েছে। শুনেটুনে মনে হল ওদের কাছে বাড়ির আশপাশে হাতির ঘোরাঘুরি তেমন কোন ব্যাপারই নয়। তবে হাতি সম্বন্ধে বলা কাহিনীগুলো যে গালগল্প নয় পরের দিন ভিডিওগুলো দেখে তার প্রমাণ পেলাম।

রামলালের বাংলোয় প্রবেশ, রাগ করে রেলিং এ “টোকা” দেওয়া, জল খাওয়া ও তেঁতুল তলায় দিবানিদ্রা । ছবিগুলো একদিনের নয়। সিসি টিভি ও ভিডিও থেকে নেওয়া।

জানা গেল, হাতি ছাড়া এসব জঙ্গলে আছে বুনো শুয়োর, খরগোস ইত্যাদি ছোটখাটো জীবজন্তু। আর আছে ভয়ঙ্কর বিষধর চন্দ্রবোড়া ও অন্যান্য প্রজাতির সাপ। কিছুদিন আগে যে বাঘের কথা কাগজে পড়েছিলাম তাকে এদিকে নয়, ঝাড়খন্ড লাগোয়া অঞ্চলে দেখা গিয়েছিল। “তবে এখন বাগান পরিস্কার, সাপের ভয় নেই। বর্ষাকালে যখন চারদিক ঝোপঝাড়ে ভরে যায় তখন একটু…”, শুনে মোটেই আশ্বস্ত হতে পারলাম না। যতটা বলছি, ততটা ভয় না পেলেও খাওয়ার পর বেসিনে হাত ধুয়ে দশ ফুট দূরে আমাদের বারান্দা পর্যন্ত রাস্তাটা ধুপধাপ শব্দকরে হেঁটে ছিলাম। সে রাতেও অবশ্য হাতি আসেনি, আর আমরা শান্তিতেই ঘুমিয়ে ছিলাম। পরদিন ব্রেকফাস্ট করার সময় শুনলাম তিনটে হাতি কাছেই এক গ্রামের কয়েকটা বাড়ির ক্ষতি করেছে।

আমাদের বনবাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। যথাসময়ে সঙ্গীতাকে বিদায় দিয়ে ঝাড়গ্রাম স্টেশনে দু’ঘন্টা বসে ভারতীয় রেলের “সুপার ফাস্ট” ট্রেণে চেপে তিন ঘন্টা দেরিতে হাওড়া পৌঁছলাম। তবে অরণ্য-কুহেলীর স্মৃতি অনেক দিন আমাদের আনন্দ দেবে সন্দেহ নেই। আর, এর পরে যদি আসি, কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়েই আসব, সে এ পথে যতোই বন্দে ভারত বা বুলেট ট্রেণ চলুক না কেন।

________

এই লেখার সঙ্গে দেওয়া হাতির ছবি সঙ্গীতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও থেকে নেওয়া।

অন্য ছবি নিজস্ব