প্রথম যখন লে-লাদাখ যাবার ইচ্ছা হয়, সেটা ২০১০ সাল। সেবার ঠিক আমাদের যাবার কয়েকদিন আগে লে শহরের আশপাশে হল মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি, এবং তার সঙ্গে ধ্বস। মারা গেলেন কয়েকশ মানুষ আর ধ্বংস হল পরিকাঠামো। কাজেই আমাদের সফর বাতিল করা ছাড়া উপায় ছিল না। সেই যে যাওয়া পন্ড হল তার পরে আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

পঁচিশ বছর পর এক বন্ধুর মুখে তার লাদাখ বেড়ানোর গল্প শুনে আমরাও ঠিক করলাম এবারে লে-লাদাখ যেতেই হবে। কিন্তু প্লেনের টিকিট বুক করার পরেই শুরু হল পাক-ভারত যুদ্ধ। আমরা তো ভেবেছিলাম এবারেও যাওয়া হবে না। ভাগ্যিস যুদ্ধ থামল।

খুব ভোরের ফ্লাইটে আমাদের যাত্রা শুরু। কলকাতার একটা নামী ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে বন্দোবস্ত করে তাঁদের গ্রুপের সঙ্গে চললাম লাদাখ ভ্রমণে। এরকম বেড়াবার সুবিধা এই যে তিনটে বড় ঝক্কি – থাকা, খাওয়া-দাওয়া ও যানবাহনের ব্যবস্থার দায়িত্ব যাত্রীদের নিতে হয় না। আর, ভাল সংস্থাগুলো ভ্রমণকারীদের স্বাচ্ছন্দের সবরকম ব্যবস্থা তো করেনই, আবার যথেষ্ট সময়ও দেন নিজেদের মতো করে একটু ঘুরে দেখার জন্য। তাই আমাদের মতো বয়স্কদের জন্য এই কন্ডাক্টেড ট্যুরগুলো খুবই ভাল।  

যাত্রা শুরুর দিন কতক আগে আমাদের ট্যুর ম্যানেজার একটা ব্রিফিং দিলেন। আমাদের জন্য ফোনে, কারণ আমরা লে এয়ারপোর্ট থেকে ওঁদের সঙ্গে যোগ দেবো। ইন্টারনেটের সৌজন্যে লাদাখ ভ্রমণের প্রস্তুতি কীরকম হওয়া উচিত তা জেনে নিয়ে ছিলাম। সমতল থেকে একেবারে সাড়ে এগারো হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ে যাওয়ায় শরীরের উপর একটু প্রভাব তো পড়বেই, বিশেষ করে অত উঁচুতে হাওয়ায় অক্সিজেন কম হওয়ায়। ঠান্ডার ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা ছিলনা কারণ বরফ আর শীতের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।   

এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিটের উড়ান। ব্রেকফাস্টে দেওয়া রোলটা শেষ হওয়ার আগেই নামা শুরু। জানালা দিয়ে চোখে পড়ল বরফ ঢাকা ঢেউ-খেলানো পাহাড়ের সারি আর মাঝে মাঝে ক্ষীণ জলধারার আভাস। সামরিক নিরাপত্তার কারণে লে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার আগে সমস্ত জানালা বন্ধ করে দিতে হয়, উপর থেকে এয়ারপোর্টের ছবি তোলা সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ।    

লে পৌঁছানোর আগে

লে বিমানবন্দরটা ছোট্ট। বাইরে আমাদের ট্যুর কোম্পানীর নামলেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে কয়েকজন অপেক্ষা করছিলেন তাদেরই একজন আমাদের নিয়ে গেলেন আমাদের নির্দিষ্ট গাড়িতে। পরিচয় হল আমাদের দুই ম্যানেজারের একজনের সঙ্গে। উনিও আমাদের সঙ্গেই চললেন হোটেলে। আরও এক দম্পতি আমাদেরই ফ্লাইটে এসেছিলেন, কিন্তু গাড়িতে না বসা পর্যন্ত জানতাম না ওঁরা আমাদেরই দলের সদস্য। হোটেলটা ছিল পনেরো কুড়ি মিনিটের ড্রাইভ।

হোটেলের লবিতে আলাপ হল আমাদের দ্বিতীয় ম্যানেজারের সঙ্গে। তিনি বলে দিলেন চুপচাপ ঘরে গিয়ে জানালা খোলা রেখে বিশ্রাম নিতে এবং শুধু খাওয়ার সময় ছাড়া ঘোরাঘুরি না করতে। এই একদিন পুরো বিশ্রামের ব্যাপারটা ওখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।   আর জল খাওয়া – একটু একটু করে বার বার, কারণ খুব শুকনো জায়গা হওয়ায় ওখানে শরীরে জলাভাব হওয়ার সম্ভাবনা। আমরা যখন লে পৌঁছলাম তখন ঠান্ডা বেশি ছিল না, শেষ-নভেম্বরের দিল্লির মতো।   

লে শহরে আমাদের হোটেল

পরদিন ঘোরাঘুরি সবই লে’র আশেপাশে। প্রাতঃরাশ করে প্রথমে আমরা চললাম হেমিস গুম্ফা – বৌদ্ধ মঠ – দেখতে। বেশির ভাগ বৌদ্ধ মঠই পাহাড়ের মাথায়। হেমিস দেখতে আড়াইশো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। তবে শুনে যতটা মনে হচ্ছে, তত কঠিন নয়।

হেমিস গুম্ফা

হেমিস গুম্ফাটা খুবই বড়ো এবং সুন্দর। যদিও বলা হয় যে এটি তৈরি হয়েছিল ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে, কারো কারো মতে এর প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়ে ছিল আরও ৫০০ বছর আগে। বিশাল গেট দিয়ে ঢুকেই প্রকান্ড একটা উঠোন। একপাশে মিউজিয়ম। সেখানে প্রধানতঃ নানাধরণের অস্ত্রশস্ত্র এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। মিউজিয়মে ঢুকতে হয় একটা   স্যুভেনিয়রের দোকানের মধ্যদিয়ে।   গুম্ফাটার উপর তলায় আছে লাইব্রেরী আর লামাদের থাকার ঘর।

মূল মন্দিরে ভূমি-স্পর্শ আসনে বসা বুদ্ধদেবের বিরাট মূর্তি। মূর্তির সামনে দুদিকে দু’ সারি চাদরে ঢাকা লম্বা নিচু টেবিল আর তাদের পিছনে লামাদের বসার আসন।  ওই টেবিলের উপর পুঁথি রেখে তাঁরা উপাসনা করেন। দেওয়ালে ও উপর থেকে ঝোলানো ছোট বড় সিল্কের কাপড়ে (এগুলিকে তংখা বলে) আঁকা বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র খুবই সুন্দর।  মন্দিরের বাইরে লেখা আছে ছবি তোলা নিষেধ, কিন্তু আমি তা দেখতে পাইনি। তাই, একজন লামা যখন ছবি তুলতে বারণ করলেন ততক্ষণে আমার কয়েকটা ছবি তোলা হয়ে গিয়েছিল।

হেমিস গুম্ফার বিখ্যাত হওয়ার একটা বিশেষ কারণ আছে। এখানকার লাইব্রেরীতেই রাশিয়ান পর্যটক নিকোলাস নটোভিচ দেখেছিলেন সেই পুঁথি যার উপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই “The Unknown Life of Jesus Christ.” বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালে। পশ্চিমী পন্ডিতরা নটোভিচের কাহিনী মানতে চাননি। তাঁদের মতে, হয় নটোভিচ মিথ্যা বলেছেন, অথবা লামারা তাঁর সঙ্গে রসিকতা করেছেন। হেমিসের প্রধান লামা ভারত সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে নটোভিচ কখনই হেমিস গুম্ফায় আসেননি। যদিও নটোভিচ এই অভিযোগ দৃঢ় ভাবে খণ্ডন করেছিলেন।

শ্রী রামকৃষ্ণের অন্যতম শিষ্য স্বামী অভেদানন্দ ১৯২২ সালে হেমিস গুম্ফা দর্শন করেন। তাঁর কাশ্মীর ও তিব্বত ভ্রমণ কাহিনীতে তিনি লিখেছেন যে তাঁর হেমিস গুম্ফায় থাকা কালীন সেখানকার লাইব্রেরীতে নটোভিচের উল্লেখিত তিব্বতি ভাষায় লেখা পুঁথি তাঁকে দেখানো হয়, এবং তার অংশবিশেষ তিনি একজন লামার সাহায্যে অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদের কিছু অংশ স্বামী অভেদানন্দের বইতে পরিশিষ্টরূপে সংযোজিত হয়েছে। অভেদানন্দজীকে বলা হয় মূল পুঁথিটি পালি ভাষায় লেখা, এবং সেটি লাসার কাছে কোন এক গুম্ফায় আছে। 

লে শহরের উপকন্ঠে সিন্ধু নদের তীরে

হেমিস গুম্ফা দেখে আমরা গেলাম কাছেই সিন্ধু দর্শনে। এই সেই সিন্ধু নদ – যার উৎস তিব্বতে মানস সরোবরের কাছাকাছি । সিন্ধু এখানে মোটামুটি সমতল জায়গা দিয়ে বইছে। বেশি চওড়া নয়, তবে জলে বেগ আছে। প্রখর রোদ আর গরমের জন্য বেশিক্ষণ থাকা যায় না। সিন্ধুর উপর একটা লোহার ব্রীজ, আর অন্যপারে কিছু গাছপালা, ঘরবাড়ি।   

থিকসে বৌদ্ধমঠ

এবার দ্রষ্টব্য থিকসে গুম্ফা। বাইরে থেকে থিকসে গুম্ফা দেখতে অনেকটা লাসায় দালাই লামার পোটালা প্রাসাদের মতো । বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়। ভিতরে লম্বা উঠোনের একদিকে এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য মৈত্রেয় বুদ্ধের মন্দির। মন্দিরের মধ্যে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু বুদ্ধদেবের মূর্তি। সাধারণতঃ এত বড় মূর্তি দাঁড়ানোই হয়। এই মূর্তিটি কিন্তু পদ্মাসনে বসা। মূর্তির শরীরের নীচের অংশ একতলায়, আর দর্শকরা দেখছে দোতলা থেকে তার উপরের অংশ। কোনমতেই সম্পূর্ণ মূর্তিটিকে   ক্যামেরায় ধরা সম্ভব নয়।

থিকসে গুম্ফার প্রবেশদ্বার

এই বিশাল মূর্তিটি ছাড়াও মন্দিরের মধ্যে রয়েছে তিব্বতি বৌদ্ধধররমের নানা মূর্তি ও চিত্র। মৈত্রেয় বুদ্ধের ডান দিকে রয়েছে বর্তমান (চতুর্দশ) দালাই লামার ফটো, আর উল্টো দিকে প্রাচীন লামাদের দেওয়ালচিত্র। ইংরিজিতে টাইপকরা একটা বিজ্ঞপ্তিতে তাঁদের পরিচয় দেওয়া রয়েছে। তার মধ্যে, তিব্বতি লামাদের মধ্যে রয়েছে ভারত, বিশেষতঃ বাংলার এক ঐতিহাসিক চরিত্র অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের ছবি। বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য লেখা আছে “Atisha।”

থিকসের বিশাল বুদ্ধমূর্তি

ইতিহাস বলছে দীপঙ্কর দ্বিতীয়বার তিব্বতে গিয়ে আর ফেরেননি। বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লি এয়ারপোর্টে শ্রদ্ধেয় দালাই লামার সঙ্গে বাংলা ও তিব্বতের মধ্যে যোগাযোগ নিয়ে কথা বলার সময় অতীশ দীপঙ্করের কথা ওঠে। উনি বলেন, তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা ও তিতিক্ষার জন্য অতীশকে তিব্বতি বৌদ্ধরা একজন প্রধান লামা হিসাবে শ্রদ্ধা করতেন এবং এখনও অন্যান্য প্রাচীন লামাদের সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করেন। থিকসে গুম্ফার দেওয়াল চিত্রে তাঁকে দালাই লামা এবং প্রাচীন লামাদের সঙ্গে এক সারিতে দেখে এ কথার যাথার্থ বুঝতে পারলাম।  

থিকসে দেখে আমরা হোটেলে ফিরলাম। পরদিন লম্বা সফর – খারদুং-লা হয়ে ন্যুব্রা ভ্যালী।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এক একটা গাড়িতে ছ’ জন করে। আমাদের ম্যানেজার দু’জনের একজন আমাদেরই গাড়িতে চললেন। এই পথে আমাদের প্রথম গন্তব্য খার্দুং-লা, এবং তারপর ন্যুব্রা ভ্যালী।

এই খার্দুং-লা নিয়েই সকলের বেশি আগ্রহ এবং আশঙ্কা।  পাস “পাশ” করা নিয়ে যাত্রীদের মনে ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা, সমতলের মানুষ – এই উচ্চতায় বাতাসে অক্সিজেনের তারল্যের সঙ্গে চট করে মানিয়ে নিতে পারি না। তাই আমাদের বারবার সতর্ক করা হয়েছিল যে কোনরকম অসুবিধা বোধ হলেই চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকতে, এবং কর্পুরের গন্ধ শুঁকতে । এ-ছাড়া, জোরে হাঁটা বা তাড়াহুড়ো করে কাজ করতেও নিষেধ করা হয়েছিল।  সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সবাই সুস্থই ছিলেন। অসুস্থ যাত্রীকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। তিনি খার্দুং-লা ও ন্যুব্রা ভ্যালী যেতে পারেন নি।

খার্দুং-লার পথে

লে শহরের সীমা ছাড়াতেই লাদাখের যে রূপ চোখে পড়ল তার সঙ্গে আমার এ পর্যন্ত দেখা কোন পার্বত্য দৃশ্যের মিল নেই। ধূসর, খুব হাল্কা গোলাপী, কোথাও নিকষ কালো আবার কোথাও বা সবুজাভ পাহাড়। কতকগুলোর মাথায় বরফের মুকুট। একেকটা পাহাড় দেখে মনে হয় যেন বালি অথবা ঝুরো পাথরের পাহাড় – মনে হয় যেন এখনই ধস নামবে। কিন্তু তা নয়। হাজার হাজার বছরের বরফের হাওয়ায় পাথরগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে এরকম হয়ে গেছে। বৃষ্টি তো এদেশে হয়ই না। শীতে বরফে ঢেকে যায় চারিদিক আর গ্রীষ্মে গলে যায়।

এইসব পাহাড়ের গা দিয়ে – কখনও বা দুই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকার মধ্যদিয়ে পীচঢালা গাড়ি চলার পথ। এঁকে বেঁকে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে অনেক উপরে, আবার নেমে এসে অন্য একটা পাহাড়ে উঠেছে। এই ভাবে ওঠা নামা করতে করতে গাড়ি চলেছে। বর্ডার রোডস অরগানাইজেশনের ইঞ্জিনিয়র আর কর্মীদের প্রশংসা করতেই হয় এত উঁচুতে আর দুর্গম জায়গায় এইরকম রাস্তা তৈরির জন্য।  

এখান থেকে সীমান্ত খুব কাছে। তাই, এ পথে সৈন্য চলাচলও বেশি। আমরা বেশ সকালে বেড়িয়েছিলাম তাই মিলিটারি কনভয়ের মধ্যে পড়তে হয়নি। এখানে সেনা চলাচলই প্রাধান্য পায়। মনে এল, অরুণাচল ভ্রমণের সময় এই অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল।

আমাদের ম্যানেজার সাহেব মনে হল একটু কম কথার মানুষ। তাই আমাদের সহযাত্রী পরিবারের সঙ্গে গল্প করতে করতে চললাম। সবুজের ছোঁয়া কোথাও নেই। ধূসর, রুক্ষ পাহাড় দেখতে একঘেয়ে লাগে। অবশ্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে চলার সময় কোন কোন পাহাড়ি নদী আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিল। আর নদীতীরের সবুজ গাছপালা আমাদের চোখকে দিচ্ছিল বহুপ্রত্যাশিত বিশ্রাম।  

একদিকে গভীর খাদ আর অন্যদিকে খাড়া এবং ন্যাড়া পাহাড় হলেও রাস্তাগুলো দেখলাম চমৎকার। অল্প কিছু জায়গায় সামান্য ভাঙা, সারানোর কাজ চলছে। কিন্তু এইরকম দুর্গম অঞ্চলে এরকম সুন্দর রাস্তা তৈরি করার জন্য বর্ডার রোডস অরগানাইজেশনকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। বি আর ওর এই প্রজেক্টটার নাম “বিজয়ক“। মাঝে মাঝে তাদের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।

রাস্তা ভাল হলেও খুবই আঁকাবাঁকা, আর তাই গাড়ির গতিবেগও সীমিত। অবশ্য একটু ধীরে না চললে এত সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যেত না। কিন্তু দুঃখের কথা, রাস্তায় ইচ্ছেমত ছবি তোলার জন্য গাড়ি দাঁড় করানোর উপায় নেই। তাই জানালা দিয়েই কিছু ভিডিও রেকর্ড করা গেল। মাত্র ৭২ কিমি পথ আসতে লাগল পাক্কা দু’ ঘন্টা।  পাহাড়ের গায়ে পাক দিতে দিতে কখন যে খারদুং-লা পৌঁছেগেলাম বুঝতেই পারলাম না। তবে, যতই খারদুং-লার দিকে এগোচ্ছিলাম, ততই পাহাড়ের উপরের অংশের বরফ যেন রাস্তার একদম গায়ে এসে লাগছিল। ভেবেছিলাম এ অঞ্চলএ বোধহয় তুষারপাত হয়ে থাকবে। কিন্তু জানলাম এ বরফ সাম্প্রতিক কালের নয় । এখানে এখনও বরফ গলেনি।

খার্দুং-লা

ম্যানেজার কোন সময়সীমা না বেঁধে দিলেও খারদুংলা পাসে আমাদের থামা শুধু ছবি তোলা ও প্রয়োজনে টয়লেটে যাওয়ার জন্য। এখানে একটা মেডিক্যাল কাম্প রয়েছে। এই ১৭৯৮২ ফুট উচ্চতায় অনেক পর্যটক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই ক্যাম্পে তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। শুনলাম মাত্র আগের মাসেই আমাদের পর্যটক সংস্থারই এক পর্যটক এতটাই কাহিল হয়ে পড়েন যে তাঁকে অক্সিজেন দিতে হয়েছিল।

কয়েক বছর আগেও খার্দুং-লার রাস্তাটা ছিল লাদাখের উচ্চতম মোটর চলাচলের রাস্তা। কিন্তু এখন উর্মিং-লা (১৯৩০০ ফুট) – বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পাস – সেই স্থান পেয়েছে। বর্ডার রোডস অরগানাইজেশনের “প্রজেক্ট বিজয়ক” খার্দুং-লার রাস্তা নির্মাণ করেছে, আর “প্রজেক্ট হিমাঙ্ক” বানিয়েছে উর্মিং-লার রাস্তাটা। তবে, এই উচ্চতার ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে এবং বিভিন্ন জন বিভিন্ন সংখ্যা দিয়ে থাকেন। আমরা সরকারি সংখ্যাই ঠিক বলে ধরে নিচ্ছি।

এই গিরিপথের দু’পাশের পাহাড়্গুলোর বরফে ঢাকা ঢাল রাস্তার এত কাছে এসে গেছে, এবং রাস্তায় বাঁকের জন্য মনে হয় যেন পথ এখানেই শেষ। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে চাইছিলেন, কিন্ত ম্যানেজার অনুমতি দিলেন না কারণ এখানে কোনরকম হুড়োহুড়ি, লাফালাফি নিষিদ্ধ; তাতে ভয়ঙ্কর শরীর খারাপ হতে পারে। উনি বললেন খারদুং-লা থেকে কিছুটা নিচে পথের ধারেই যথেষ্ট বরফ পাওয়া যাবে। সেখানে আমাদের যথেষ্ট সময় দেওয়া হবে বরফের উপর হাঁটা ও আনন্দ করার জন্য। ম্যানেজার কথা রেখেছিলেন।

মিনিট পনেরো খারদুং-লাতে কাটিয়ে আমাদের গাড়িগুলো খানিক নিচে একটা অপূর্ব সুন্দর জায়গায় থামল। পথের একদিকে বরফের ঢাল নেমে এসে পথের ধারে শেষ হয়েছে। দলের সবাই ওই আধা নরম বরফে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে উপরে উঠে দেখেন বেশ বড় একটা ময়দান, যেখানে বরফ নেই, বরং ঘাষ আছে। কেউ কেউ আরও একটু উপরে উঠেছিলেন। অনেকে বরফের ঢালু দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছিলেন। বরফের দেশে অনেক বছর বাস করার অভিজ্ঞতা থাকায় বরফ আমাদের এখন দূর থেকেই দেখতে ভাল লাগে। আমরা তাই এদিক ওদিক ঘুরে কিছু ছবি তুললাম।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ওই জায়গাটায় কাটিয়ে আমরা চললাম ন্যুব্রা ভ্যালীর ডিসকিটে আমাদের  হোটেলে। তবে তার আগে একটা সুন্দর বৌদ্ধ মঠ দেখলাম। ভর দুপুরে সূর্যদেব তখন মাথার উপর আগুণ ছড়াচ্ছেন, কিন্তু মঠের ভিতরটা বেশ ঠান্ডা। কিছুক্ষণ সেখানে পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধদেবের সামনে বসলাম। একজন বর্ষীয়ান লামা প্রসাদ দিচ্ছিলেন – আমাদের নকুলদানার মতো কোন মিষ্টি।  তাঁর কাছে জানা গেল এই মঠটি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের হলুদ-টুপি সম্প্রদায়ের, এবং দালাই লামাও এই সম্প্রদায়ভুক্ত।  তিনি এই মঠে অনেকবার এসেছেন।  মঠের বাইরে ১০৬ ফুট উঁচু মৈত্রেয় বুদ্ধের সুন্দর মূর্তিটিরও তিনিই  আবরণ উন্মোচন করেছিলেন।  

ন্যুব্রা উপত্যকার একাংশ
ডিসকিটের বৌদ্ধ মঠ

ডিসকিট শায়ক (Shayok) নদীর উপত্যকায়, আর তাই এখানে বেশ সবুজ গাছগাছালি। ফলের গাছের মধ্যে অ্যাপ্রিকটই প্রধান। এখানকার আবহাওয়াও অনেক সহনীয়। যখন তিব্বতে কোন আধুনিক রাস্তা ছিলনা, সেই সময় তিব্বত, চিন ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের একটা রাস্তা ছিল এই সায়ক উপত্যকার উপর দিয়ে। আর এখানেই দেখা যায় দু’ কুঁজ ওয়ালা ব্যাক্ট্রিয়ান উট। তাদের গল্প হবে একটু পরে। মঠ দেখে আমরা গেলাম হোটেলে। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে হওয়ায় আশপাশের দৃশ্য খুবই সুন্দর।

ন্যুব্রা উপত্যকায় পর্যটনস্থল

লাঞ্চের পর আমরা চললাম নুব্রা ভ্যালীর খোলা প্রান্তরে শীতল মরুভূমির আনন্দ উপভোগ করতে। ডিসকিট থেকে হুন্ডার – এই বিশাল প্রান্তরেই রয়েছে বালিয়াড়ি আর উটের পিঠে চড়া, তীরন্দাজি ইত্যাদির ব্যবস্থা। এই ময়দানের একদিকে পাহাড়ের সারি – ধূসর, রুক্ষ যার কোল ঘেঁষে বইছে শায়ক নদী; আর অন্যদিকে অনেক দূরে গ্রামের ঘরবাড়ি ও বৌদ্ধ মঠ।

এই মরু প্রান্তরে দু’ কুঁজ ওয়ালা উটের পিঠে বেশ কিছুটা ঘোরা গেল। দুটো কুঁজের মাঝে বসার ব্যবস্থা – এক কুঁজের তুলনায় খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের দলের একটা উট তার গা চুলকোবার জন্য আমার উটের পেটটা বেছে নেওয়ায় আমার জিন্সের ডান পা টা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। আর আমার উটটা অন্য উটের গা রগড়ানি এড়াবার জন্য মাঝে মাঝেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছিল। সে আর এক বিপদ। শেষে উট ওয়ালা অন্য উটটাকে পিছনে করে দেওয়ায় শান্তি।

লগবগ করতে করতে উট চলেছে বালির উপর দিয়ে – একদিকে বিশাল পাহাড়ের ঢালু গা নেমে এসেছে, আর অন্যদিকে অনেক দূরে একটা বৌদ্ধ মঠ। একধার দিয়ে বয়ে চলেছে শায়ক নদী। চারিদিকের দৃশ্য বর্ণনা করা আমার অসাধ্য। কিন্তু ভাবছিলাম এই উটের পিঠে চেপে কি করে মাইলের পর মাইল যেত সেকালের ব্যবসায়ীরা!

ন্যুব্রা ভ্যালী থেকে ডিসকিট বৌদ্ধ মঠের দৃশ্য

শেষে উটের সারিকে যেখানে দাঁড় করালো – হঠাৎ দেখে মনে হয় সামনে যেন এক ধূসর সমুদ্র। উটে চড়ার পালা শেষ করে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। কোন কোন পর্যটক তীরন্দাজি করছেন দেখলাম। শায়কের ধারে কয়েকটা চায়ের দোকান, যেখানে নুডলস, মোমো ইত্যাদি পাওয়া যায়। তারই একটাতে চা খেয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম আকাশে তখন সূর্যের শেষ রক্তিম ছটা পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে।

ন্যুব্রায় উটের পিঠে

পরদিন ব্রেকফাস্টের পর আবার পথে। এবার লে তে ফেরা – প্যাঙ্গং লেক আর চ্যাং-লা হয়ে। ডিসকিট থেকে প্যাঙ্গং-এর দূরত্ব প্রায় ২৩০ কিমি । পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। আঘাম বলে একটা জায়গা থেকে প্যাঙ্গং যাবার দুটো রাস্তার একটা বন্ধ থাকায় আমাদের যে পথে যেতে হল সেটাই সম্ভবত এখানকার সবচেয়ে কষ্টকর ও কঠিন রাস্তা। 

কিছুটা যাওয়ার পরে মনে হচ্ছিল আমরা কোন শুকিয়ে যাওয়া নদীর খাতের মধ্যদিয়ে চলেছি ছোটবড় গোল গোল পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে। রাস্তার প্রায় সমান উচ্চতায় বয়ে চলেছে শায়ক নদী। নদীতে জল বেড়ে গেলে এ পথে আর যেতে হতো না। রাস্তা যত খারাপই হোক, এ পথের দৃশ্য অপূর্ব। একজায়গায় পথের উপর দিয়ে জল বইছে, আমরা তার উপর দিয়েই চললাম। এই ঘুরপথে আমাদের একটু কষ্ট হলেও, দূর থেকে ঘননীল প্যাঙ্গং-এর ঝলক সেসব ভুলিয়ে দিল। ঘড়িতে তখন দুপুর বারোটা বাজতে চলেছে। 

প্যাঙ্গং-এর প্রথম ঝলক

ভারত-তিব্বত সীমান্তের এই প্যাঙ্গং লেক বা, প্যাঙ্গং সো আয়তনে প্রায় ৭০০ বর্গ কিমি হলেও ভারতের অধিকারে রয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ আর চিনের ৫০ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশের অধিকার নিয়ে মতানৈক্য আছে। সে যাই হোক, প্যাঙ্গং লেকের সৌন্দর্য, এক কথায়, অনৈসর্গিক। এরকম নীল জল হ্রদ আমি এর আগে কোথাও দেখিনি। উপরে মেঘ-শূন্য নীল আকাশ আর নীচে গাঢ় নীল জল, আর সেই জলে পড়েছে তীরবর্তী পাহাড়গুলোর ছায়া। এ দৃশ্য চুপ করে বসে উপভোগ করার।

জল কনকনে ঠান্ডা, কিন্তু কেউ কেউ দেখলাম প্যান্ট গুটিয়ে সেই জলে নেমে পড়েছেন। চলেছে নানা ভাবে সেলফি তোলা। মাঝে মাঝে ভারতীয় সেনার মোটর বোট প্যাঙ্গং-এর নীল জলে সাদা ফেনা তুলে। চড়া রোদে গায়ে গরম জামা রাখা গেলনা। লেকের ধারে কোথাও কোন ছায়া নেই। কিছু ছোট ছোট চায়ের দোকান রয়েছে। মনে হল তারা লেকের ধারে ঘোরার জন্য স্কুটার ভাড়া দেয়। শুনলাম সূর্য ঢললেই শন শন করে রক্ত জমিয়ে দেওয়া ঠান্ডা হাওয়া দেয়। এখানে পর্যটকদের থাকার ভালই ব্যবস্থা রয়েছে ছোট ছোট স্বয়ংসম্পূর্ণ “টেন্টে”।  এগুলো দেখলাম আসলে ঘরের মতোই এবং কিছু পর্যটক রয়েছেনও।

চমৎকার একটা লাঞ্চের পরে আবার পথে – ছ্যাং-লা (পাস) হয়ে লে। ছাং-লা (১৭৬৮৮ ফূট) খার্দুং-লার চেয়ে উচ্চতায় খানিকটা কম হলেও এখানে নাকি বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খার্দুং-লার চেয়ে কম, এবং সেই কারণে এখানে টেনেটুনে দশ মিনিটের বেশি থাকা উচিত নয়। এমনকি যারা বাইকে করে আসছে তারাও দেখলাম একটা দুটো ছবি তুলেই তাড়াতাড়ি ছাং-লা ছেড়ে যাচ্ছে। ছাং-লা থেকে লে’র রাস্তা খুবই ভাল, এবং সন্ধ্যার আগেই আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন যাওয়া হবে কার্গিল, দ্রাস এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে।  

কার্গিল – নামটা শুনলেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ১৯৯৯ সালে এই কার্গিলেই পাক সেনা সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘন করে ভারতের মাটিতে ঢুকে পড়েছিল এবং টাইগার হিল ও অন্যান্য পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান নিয়ে সরাসরি লে–শ্রীনগর রাজপথকে নিশানা করেছিল। স্থানীয় কিছু মেষপালকের কাছে এই খবর পাওয়ার পর আমাদের সেনাবাহিনী যে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের বাধা তুচ্ছ করে এই আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দিয়ে, শত্রুদের নির্মূল করে দেশের অখন্ডতা রক্ষা করেছিল তা ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেই কার্গিলে যাচ্ছি, দ্রাসে ওই যুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ও প্রদর্শনশালা দেখব এবং নিয়ন্ত্রণ রেখার কিছুটা কাছে যেতে পারব, এই চিন্তায় স্বাভাবিক ভাবেই আমরা সবাই অল্পবিস্তর উত্তেজিত ছিলাম।

লে–শ্রীনগর রাজপথ, যা কার্গিলের উপর দিয়ে গেছে, সত্যিই চমৎকার রাস্তা। পথ তীরের মতো সোজা চলে গেছে। দু’ পাশে লাদাখের ধূসর প্রান্তর, আর একটু দূরে বিশাল পর্বতমালা। এই পথে নিম্মু গ্রামের কাছে জান্সকার নদী এসে সিন্ধু নদে মিশেছে। তবে, আমরা সেই সঙ্গম দেখব ফেরার পথে। এখন লক্ষ্য কার্গিল। রাস্তা ভাল হলেও লে থেকে কার্গিলের ২০০ কিমি যেতে আমাদের লেগেছিল পাঁচ ঘন্টা। মাঝে মাঝে যখন এক পাহাড় পেরিয়ে আর এক পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তা একটু আঁকাবাঁকা। কিন্তু সেই জায়গাগুলোর দৃশ্য ভারী সুন্দর।

কার্গিল শহরে আমাদের হোটেলে লাঞ্চ করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম দ্রাসের উদ্দেশ্যে। এই দ্রাসের কাছেই টাইগার হিল ও অন্যান্য পাহাড়ের চূড়ায় হয়েছিল কার্গিল যুদ্ধ। আমরা প্রথমেই এই স্মৃতিসৌধ এবং প্রদর্শনীটি দেখলাম।

স্মৃতিসৌধের গেটের কাছে আমাদের দাঁড়াতে হল। সেনাবাহিনীর একজন আধিকারিক এই পরিসরটির গুরুত্ব এবং এখানে পালনীয় কিছু নিয়মের ব্যাপারে আমাদের বললেন। গেট থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত। এই পথের দু’ধারে সারি সারি জাতীয় পতাকা এবং কার্গিল যুদ্ধে পরমবীর চক্র ও মহাবীর চক্র পদক প্রাপ্ত জওয়ান এবং অফিসারদের আবক্ষ মূর্তি। মূর্তির নিচে ফলকে তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং যে কারণে তাঁরা এই পদক পেয়েছিলেন তা লেখা আছে।  ওই যুদ্ধে মোট চার জন পরমবীর চক্র ও এগারো জন মহাবীর চক্রে সম্মানিত হয়ে ছিলেন। পরমবীর চক্র প্রাপ্তদের মধ্যে দু’জন মরণোত্তর এই পদক পান।

দ্রাসের স্মৃতিসৌধ

স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখলাম। একজন আধিকারিক সুন্দর ভাবে প্রতিটি প্রদর্শিত বস্তুর ব্যাপারে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তবে ভিড়ের জন্য মাঝারি মাপের এই প্রদর্শনীটি খুব মন দিয়ে দেখা হয়নি। এইসময় একটা মজার ব্যাপারও আমাদের “তাল” কেটে দিয়েছিল। আমাদের গাইড হঠাতই আমাদের সকলকে প্রদর্শনশালার বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষার পর আবার ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম।  

এই ঘটনার কারণ, উনি বললেন, ওঁর ওয়াকিটকিতে একটা সাংকেতিক বার্তা আসে, যার অর্থ, “জরুরী অবস্থা” । অথচ তেমন কিছুই কারো চোখে পড়েনি। তাই আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে উনি খোঁজ নিচ্ছিলেন ব্যাপারটা সম্পর্কে। আসলে, ওঁদের ইউনিটের এক সৈন্য লম্বা ছুটি কাটিয়ে সেই দিনই কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনিই ভুল সংকেত ব্যবহার করায় এই বিপত্তি। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কোন ঝুঁকি নিতে পারে না।

স্মৃতিসৌধ দেখে আমরা চললাম লাইন অফ কন্ট্রোলের কাছে একটা ভিউ পয়েন্টে। রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় এই পথে আমাদের ছোট গাড়ি নিতে হল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। এখানে বেশ কিছুটা উঁচু একটা টিলার মাথায় টেলিস্কোপ লাগানো আছে, যা দিয়ে দূরের আকাশছোঁয়া পাহাড়ের মাথায় আমাদের সেনাবাহিনীর বাংকারগুলো ভাল দেখা যায়। খালি চোখে, দেখিয়ে না দিলে, ওগুলোকে সাদা সাদা বিন্দু ছাড়া কিছুই মনে হয়না। পাহাড়ের গায়ে ঘোড়া-খচ্চর যাওয়ার পাকদন্ডী পথ। সীমানায় মোতায়েন সৈন্যদের প্রয়োজনীয় রসদ ওই পথেই তাঁদের ঘাঁটিতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে পাহাড়ের মাথায় বাংকার

ওই ঘাঁটিগুলোকে পয়েন্ট বলা হয় – যেমন, পয়েন্ট নম্বর …, এইরকম। কার্গিল যুদ্ধে শত্রুসৈন্য ওই পয়েন্টগুলো চুপিসাড়ে কব্জা করেছিল, কারণ আগে ওই জায়গাগুলোতে স্থায়ী ঘাঁটি তো নয়ই, এমন কি বিশেষ টহলদারিও করা হত না। যাইহোক, ওই পয়েন্ট বরাবরই রয়েছে নিয়ন্ত্রণ রেখা। আর, ওই বেদখল হওয়া পয়েন্টগুলো পুনর্দখলের জন্যই কার্গিলে সেনাবাহিনীকে চালাতে হয় “অপারেশন বিজয়” এবং বিমানবাহিনীকে “অপারেশন শ্বেতসমুদ্র (সফেদ সাগর)” ।

ফিরে এলাম কার্গিল শহরে “সুরু” নদীর ধারে আমাদের হোটেলে। খরস্রোতা সুরু শহরের মধ্যদিয়েই বয়ে চলেছে। এখানে প্রচুর ফলের গাছ, বিশেষ করে । আপেলও আছে। হোটেলের কাছেই একটা দোকান থেকে কাশ্মীরী কাওয়া চা, শুকনো অ্যাপ্রিকট ইত্যাদি কেনা হল।

কার্গিল থেকে লে ফেরার পথে মুলবেকে রয়েছে তিরিশ ফুট উঁচু, পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি ও বৌদ্ধ গুম্ফা। আধুনিক পন্ডিতদের মতে এটি ১২০০ থেকে ১৩০০ বছরের পুরনো, যদিও এক মতে এটি কুষাণ যুগের, কাজেই অন্ততঃ ১৮০০ বছরের পুরনো। । সে যাই হোক, মুর্তিটি নিঃসন্দেহে খুবই প্রাচীন।

এরপরে আমরা থামলাম “মুনল্যান্ড” বা “চাঁদের দেশে” । এখানে, হাজার হাজার বছরের রুক্ষ আবহাওয়ায় পাহাড়ের গা ক্ষয়ে ক্ষয়ে এমন উঁচুনিচু, অদ্ভুত সব আকৃতির হয়েছে যে স্থানীয় মানুষ একে সাথর্ক নাম দিয়েছে – মুনল্যান্ড। এ জায়গাটা এখন পর্যটকদের অবশ্য-দ্রষ্টব্য একটা স্থান। ছবি তোলার আদর্শ জায়গা, তাছাড়া লম্বা সফরে ছোট্ট বিরতি দিয়ে এক পেয়ালা চা খেতে মন্দ লাগল না ।

লে শহরের কাছেই নিম্মু গ্রামের কাছে জান্সকার নদী সিন্ধু নদে এসে মিলেছে। এই সঙ্গমে দুটি জলধারার আলাদা রং স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু এই ভর দুপুরে রঙের তারতম্য বুঝতে পারলাম না। এখানে একদল বাইকারের সঙ্গে আলাপ করলাম, যারা শ্রী লঙ্কা থেকে কাশ্মীর ও লাদাখ ঘুরতে এসেছে। বাইকগুলো অবশ্য শ্রী নগর থেকে নিয়েছে, আবার সেখানেই ফেরত দিয়ে দেশে ফিরে যাবে। 

সিন্ধু ও জান্সকারের সঙ্গম

অসাধারণ অভিজ্ঞতার এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল লাদাখে। মনে হয় এই অপার সৌন্দর্যের ভূমি না দেখলে ভারতদর্শন হবে অসম্পূর্ণ ।