আবার উত্তরাখণ্ডে। হিমালয়ের আকর্ষণ এরকমই। বার বার ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে, কখনও পুরনো হয়না।

কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ে, মনে হয়, হিমালয়ের কিছু অঞ্চল একটু বেশি শহুরে হয়ে উঠছে, কিন্তু তাতে ভাললাগায় কিছু কম পড়েনা। প্রথমবার কুমায়ুনে এসেছিলাম প্রায় তিরিশ বছর আগে। তারপরে ২০২১ সালে মুন্সিয়ারি যাওয়ার পথে একবার থেমেছিলাম শ্যামলাতলে, কিন্তু সেবার থাকা হয় নি। চার বছর পরে আবার আসা। তবে, এবারে পাহাড়ে আসার উদ্দেশ্য নিছকই নির্জনবাস; দিল্লির দেওয়ালী, থুড়ি, শব্দাবলী ও ধূম্রাবলীর অত্যাচার থেকে অনেক দূরে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে শান্তিতে ক’টা দিন কাটানো।

প্রথমবারের গল্পটা আগে বলি। আমাদের ছেলেরা তখন বেশ ছোট। দিল্লির আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস থেকে সরকারি বাসে সূর্য ওঠার আগেই নেমেছিলাম টনকপুরে। সেই অন্ধকারের মধ্যেই একটা আধখোলা জীপে শুরু হয় যাত্রা।  উদ্দেশ্য ২৩ কিমি দূরে সুখীডাং নামে এক পাহাড়ি গন্ডগ্রামের কাছে শ্যামলাতল বিবেকানন্দ আশ্রম। সে সময় এই আশ্রম প্রচারের আলোর বাইরেই ছিল। আমরা গিয়েছিলাম দিল্লি রামকৃষ্ণ আশ্রমের অধ্যক্ষ পূজনীয় স্বামী গোকুলানন্দের প্রেরণায়, তাঁর গুরুদেব পূজনীয় স্বামী বিরজানন্দজির প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে ক’দিন কাটাতে।

বিবেকানন্দ আশ্রম, শ্যামলাতল
বিরজানন্দজির বাড়ি, শ্যামলাতল

দু’পাশে ঘন জঙ্গল। সবদিকেই নিবিড় অন্ধকার আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া । সেই আলোয় মাঝে মাঝে জ্বল জ্বল করে উঠছিল যেসব চোখ তাদের মালিক হরিণ না হায়না, শেয়াল না লেপার্ড জানি না। জীপের পিছনটা খোলা, আর সেখানে দুই ছেলেকে চেপে ধরে বসে তাদের মা। আমি ড্রাইভারের পাশে। যাহোক, একটু আলো দেখা দেওয়ার কিছু পরে আমরা নিরাপদেই আশ্রমে পৌঁছেছিলাম। বেশ মনে আছে, সুখীডাং থেকে আশ্রম পর্যন্ত রাস্তাটা ছিল পাথুরে এবং বেশ সরু।

শ্যামলাতলের একটি পথ
বিরজানন্দজির ঘর

কিন্তু চারপাশে যত জঙ্গলই থাক, বা আশ্রমের ব্যবস্থাদি যত সাধারণই হোক, বিরজানন্দজির প্রতিষ্ঠা করা সেই ছোট্ট আশ্রমটা আমাদের যে কী ভাল লেগেছিল তা বলে বোঝানো যায় না। সকাল-সন্ধ্যেয় আশ্রমের “ঠাকুর ঘরে” (তখন আলাদা মন্দির ছিলনা) পুজোর ও আরতির সময় বসা, মহারাজদের গান, লাইব্রেরী ঘরে ওঁদের সঙ্গে নানা কথাবার্তা আজও মনে আছে।

সারদা কুটির – পুরনো অতিথিগৃহ
বাগানের একাংশ

আমাদের দুই ছেলেও ওই পরিবেশে বেশ আনন্দে ছিল। যে তিন দিন ওখানে ছিলাম, আমাদের কাজ ছিল দুপুরে পাহাড়ি পাকদন্ডী রাস্তায়, ওক গাছের পাতলা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বেশ নীচে শ্যামলাতাল (তাল মানে জলাশয়) ও অন্যান্য তালগুলো “আবিষ্কার” করা। ওখানে, যতদূর মনে পড়ে, তিন-চারটে তাল ছিল, যার মধ্যে শ্যামলাতালটাই সবচেয়ে বড়। জল বেশ কম। পাড়ে গ্রামের মোষ চরছে। একটা তালের পথে নামার সময় দেখি, একখন্ড চাষের জমির এক কোনে ছোট্ট একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা অবাক হয়ে আমাদের দেখছেন। উনি আমাদের তালের ধারে প্রচুর জোঁক আছে, এবং হিংস্র পশুদের আনাগোনা সম্বন্ধে সাবধান করে আর নীচে নামতে বারণ করলেন। উনি ওই জমির ফসল পাহারা দেবার জন্য ওইরকম ঘন বনের মধ্যে একা থাকেন।  

ঘন জঙ্গলের মধ্যে কৃষকের কুটির
টনকপুর পয়েন্ট থেকে সারদা নদী

মহারাজদের কাছে শুনেছিলাম ওখানে লেপার্ড এবং ভাল্লুক যথেষ্ট ছিল। যদিও জঙ্গলে ঘোরাঘুরির সময় সে কথা আমাদের মাথায় থাকত না, তবে গোরু ও মোষ ছাড়া অন্য কোন জন্তু জানোয়ার আমাদের চোখে পড়েনি। আর একদিন একজন মহারাজ আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন আশ্রম থেকে বেশ কিছুটা উপরে টনকপুর পয়েন্টে।  দেখিয়েছিলেন অনেক নীচে সারদা নদী ও নেপাল সীমান্ত, এবং দূরে একটা পাহাড় – যার উপরে পূর্ণগিরি দেবীর মন্দির। 

টনকপুর পয়েন্টের পথে ছোট্ট শিব মন্দির
হিমশৈল – শ্যামলাতল থেকে

এবারে কাঠগোদাম স্টেশন থেকে সোজা গাড়িতে শ্যামলাতল আশ্রমে যাওয়া। রাস্তা অত্যন্ত ভাল, এমনকি সুখীডাংকেও চেনা যায় না। পাথুরে সরু রাস্তা এখন পীচঢালা চওড়া পথ, দু’পাশে কয়েকটা বাড়ি ও দোকান, যা আগের । ওকের জঙ্গল প্রায় নেই, তাই নীচের শ্যামলা তাল অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। তাতে নীল জল টল টল করছে। ২০২১শে  যখন মুন্সিয়ারির পথে এখানে এসেছিলাম কয়েক ঘন্টার জন্য, তখন দেখেছিলাম শ্যামলা তালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছিল সুন্দর এক পর্যটন কেন্দ্র। এবারে দেখি, সেই বাড়িটার প্রায় পোড়ো বাড়ির দশা। অবশ্য জলাশয়টা সংস্কার করা হয়েছে। নতুন করে রাস্তা সারানো হচ্ছে। শুনলাম, সরকার নাকি এই অঞ্চলের পর্যটন নিয়ে আবার নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।   

শ্যামলা তাল
সূর্যাস্ত – শ্যামলাতল আশ্রম থেকে

শ্যামলাতল আশ্রম কিছুটা বদলে গেছে। নতুন মন্দির, অফিস ঘর ইত্যাদি আগেই দেখেছিলাম। দাতব্য চিকিৎসালয়টা  আগের মতোই আছে। নতুন অতিথিনিবাস – যেখানে আমাদের এবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল – খুবই সুন্দর এবং আধুনিক। আমাদের সেই পুরনো অতিথিনিবাস – এখন সারদা কুটির – দিব্যি রয়েছে। একটু সারানো হয়েছে শুধু। তার উল্টোদিকে স্বামী বিরজানন্দ মহারাজের ছোট্ট দোতলা বাড়ি। নীচে গোটা দুই ঘর, উপরে কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা বারান্দা। মহারাজের ঘরটা তালা দেওয়া। গতবারে এই ঘরটিতে একটা ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে মহারাজের ব্যবহৃত বাঘছালের আসন, কমন্ডলু ও অন্যান্য কিছু জিনিস বার করে আমাদের দেখানো হয়েছিল।

এবার, বন্ধ দরজার গরাদের মধ্যদিয়ে দেখলাম দেওয়ালে তাঁর অনেক ছবি, এবং সেই বাঘছাল, কমন্ডলু, লাঠি, ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস গুছিয়ে রাখা রয়েছে। বারান্দায় আসন এবং টুল রাখা আছে – যাঁরা কিছু সময় একান্তে কাটাতে চান তাঁদের জন্য এটি আদর্শ জায়গা। শ্যামলাতল আশ্রম এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেছে। ভক্তদের সমাগম যথেষ্ট, কিন্তু দেখলাম অনেকেই এই ঘরটি একবার দেখেই পূর্ণগিরি, টনকপুর পয়েন্ট বা শ্যামলা তাল, ইত্যাদি দেখতে যাচ্ছেন। কাজেই এখানকার ধ্যান-গম্ভীর ভাবটি অক্ষুণ্ণ আছে।

বিরজানন্দ মহারাজের ঘরের বাইরে ডান দিকে সাধারণতঃ কেউ যান না। ফলে ওখানে সেই অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশ, অবিশ্রাম পাখির ডাক, অপার শান্তি। অজস্র পাহাড়ি বুলবুল ও খুব ক্ষুদে ক্ষুদে হানিসাকার জাতীয় পাখি ঝোপে ঝোপে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সামনের পাহাড়ের গায়ে গ্রামের বাড়িঘর, ধাপে ধাপে নেমে আসা ফসলের ক্ষেত, এবং ঢেউয়ের মতো সবুজ পাহাড়ের পিছনে হিমশৈল হিমালয়। এক কথায়, শ্যামলাতল আশ্রম, নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সত্ত্বেও তার শান্ত ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ এখনও ধরে রেখেছে।

আমরা তিনদিনের জন্য শ্যামলাতলে থাকতে চেয়েছিলাম। সেই হিসেবে কালীপুজোর দিনই আমাদের মায়াবতী যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে তো পুজো-আচ্চার কোন ব্যাপার নেই, তাই আমরা ভাবছিলাম যদি শ্যামলাতলে একটা দিন বেশি থাকা যায়। আশ্রমের দিক থেকে কোন আপত্তি ছিলনা, কিন্তু মায়াবতীতে যে বুকিং রয়েছে, তার কি হবে? সাত পাঁচ ভেবে মহারাজের কাছে আবেদন রাখা হল, এবং উনিই মায়াবতীতে ফোন করে আমাদের একদিন পরে সেখানে পৌঁছানোর জন্য যাতে কোন অসুবিধেয় না পড়তে হয় তার ব্যবস্থা করেদিলেন।  

কালীপুজোর দিন সকাল থেকে আশ্রমে ব্যস্ততা। সবাই মিলে মোমবাতি দিয়ে পুরো আশ্রম সাজানো হল। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ পুজোর আয়োজনে সাহায্য করায় উদ্যোগী হলেন। সন্ধ্যেয় শ্যামলাতল আশ্রম দীপাবলীতে সেজে উঠল। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। তার মধ্যে প্রদীপ ও মোমবাতির আলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। নিকটবর্তী গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এল দল বেঁধে উৎসবে যোগ দিতে। পুজো চলাকালীন এদের সমবেত ভক্তি-গীতি এক অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

দীপাবলীর আলোকসজ্জা
দীপাবলীর আলোকসজ্জা

পুজোর পর বাচ্চারা আশ্রম প্রাঙ্গণে খুব আনন্দ করে বাজি পোড়ালো। আশ্রম থেকেই তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাদের এই আনন্দ উৎসবে সন্ন্যাসী এবং আমরা, অতিথিরাও যোগ দিলাম। এরপরে প্রসাদ বিতরণ। এই বিশেষ প্রসাদ বাচ্চাদের সঙ্গে আমরা সবাই পেলাম।

গ্রামের ছেলেমেয়েদের দীপাবলীর ভোজ

পরদিন সকাল ন’টায় মায়াবতীর পথে শ্যামলাতল ছাড়লাম। প্রায় আড়াই ঘন্টার রাস্তা। তিরিশ বছর আগে এই পথ অনেক সরু ছিল। জায়গায় জায়গায় লেখাছিল “হর্ণ বাজানো” নিষেধ, কারণ শব্দের কম্পনে পাথর খসে পড়তে পারে। ২০২১ সালে যখন আসি, তখন পাহাড় ভেঙে রাস্তা চওড়া করার কাজ চলছিল – ধূলোয় ধূলো। সেই রাস্তা এখন অনেক চওড়া হয়েছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টিতে ধস নামায় ভেঙে গেছে – সারানোর কাজ চলছে। বাঁ দিকে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে চলতি নদী। এর কথা পড়েছিলাম উমাপ্রসাদের ভ্রমণ কাহিনী আর জিম কর্বেটের শিকারের গল্পে। 

কর্বেটের মানুষ-খেকো শিকারের প্রায় সব গল্পের পটভূমিই কুমায়ুন হিমালয়ের এই অংশটা।  তখন ছিল শুধু পায়েচলার পথ, ঘন জঙ্গল আর পাকদন্ডী। ভাবলেই ভয় হয়, মানুষ-খেকো বাঘের খোঁজে কী অসম্ভব পরিশ্রম করেছিলেন কর্বেট, আর তাঁর সাহসেরও তুলনা হয় না। তবে, তাঁর কাছে তো তবু রাইফেল থাকত, কিন্তু যে তীর্থ-যাত্রীরা এবং সাধু-সন্ন্যাসীরা কোন অস্ত্র-শস্ত্র ছাড়াই এখানকার সেই সময়কার দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যদিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতেন, স্বয়ং কর্বেট তাঁদের সাহস এবং বিশ্বাসের প্রশংসা করেছেন তাঁর লেখায়। তারও বেশ কয়েক বছর আগে ১৮৯৯ সালে, স্বামীজির প্রেরণায় ক্যাপ্টেন ও মাদার সাভিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নের সাধন স্থল – মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম। স্বামীজি তাঁর সাধের এই আশ্রমে এসেছিলেন মাত্র একবার, ১৯০১ সালের জানুয়ারী মাসে। থেকেছিলেন দু’ সপ্তাহ। 

ধরমগড় পাহাড়ের কোলে মায়াবতী এখনও ঘন বনজঙ্গলে ঘেরা – বাইরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে। সবচেয়ে কাছের ছোট্ট শহর লোহাঘাট ১০ কিমি দূরে। দেখতে দেখতে আমরা চম্পাবত এসে পড়লাম। চম্পাবত বেশ বড় জেলাশহর। যতদূর মনে পড়ে, প্রথম যখন এসেছিলাম, ১৯৯৬ সালে, পথের ধারে একটা বোর্ডে লেখা ছিল – “The Man eater of of Champawat was killed by Jim Corbett here in 1907”। এবারে সেটা চোখে পড়ল না।

প্রকৃতির কোলে মায়াবতী আশ্রম
ঐতিহাসিক অতিথিগৃহ – এখানে আমরা ছিলাম প্রথমবার

আবার মায়াবতী। কালের নিয়মে বদল এসেছে এখানেও। এখন লোহাঘাট থেকে আশ্রম পর্যন্ত সুন্দর পীচঢালা রাস্তা। দর্শনার্থীদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। নতুন, আধুনিক সুবিধা-যুক্ত অতিথি শালা তৈরি হয়েছে। আবার পুরনোগুলোরও সংস্কার হয়েছে। অনেক ভ্রমণার্থী আবার আলমোড়া থেকে বা মুন্সিয়ারি থেকে ফেরার পথে একবেলার জন্য মায়াবতী  ঘুরে যান। আশ্রমের হাসপাতালটা আগের চেয়ে বড় হয়েছে। এটুকু “উন্নয়ন” ছাড়া মায়াবতীর নির্জনতা, প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ আগের মতোই আছে।

সংস্কারের পরে পুরনো গেস্ট হাউস, সামনে থেকে
ঋষি কুটির – নতুন দুটি অতিথিশালার একটি

এবারে আমাদের থাকা নতুন গেস্ট হাউসে। আগের বারে ছিলাম ঐতিহ্যমন্ডিত একটা কুটিরে, যেখানে ভগিনী নিবেদিতা, সপরিবারে আচার্য জগদীশ চন্দ্র এবং অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিরা অনেকবার থেকেছেন। সেই বাংলোটিরও সংস্কার হয়েছে, কিন্তু বাইরে থেকে একই রকম। 

মায়াবতী আশ্রমের হাসপাতাল
আর একটি পুরনো অতিথি গৃহ

আশ্রমে থাকার একটা আলাদা আনন্দ আছে, যদিও অনেকের কাছে এখানকার অনুশাসন কষ্টকর লাগতে পারে। বাঁধা নিয়মে, ঘড়িধরে সারতে হনে দৈনন্দিন সব কাজকর্ম। তার বাইরে কিন্তু শান্তিতে একান্তে পড়াশোনা করার বা শুধুই চুপ করে থাকার ও প্রকৃতিকে উপভোগ করার অখন্ড অবসর। যাঁরা ধ্যান-পরায়ণ তাঁদের জন্য মায়াবতীর মতো জায়গা নেই। গেস্ট হাউসে ধ্যানঘর রয়েছে। তাছাড়া যে কোন গাছের তলায় বাঁধানো বসার জায়গায় বসলেই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য।

ধরমগড়ের রাস্তা
পাখীর স্বর্গরাজ্য

আশ্রম থেকে কিছুটা উপরে, পাহাড়ি পথে জঙ্গলের মধ্যদিয়ে ধরমগড় যাওয়ার রাস্তায় আড়াই কিলো মিটার দূরে একটা টিলার উপর বিবেকানন্দ পয়েন্ট। এখানে রয়েছে জালের দরজা দেওয়া একটা সাধন-কুটির। চারিদিকে ঘন জঙ্গলের মাঝে এই কুটির বহু সাধকের তপস্যাস্থল। মায়াবতীর ম্যানেজার মহারাজ আমাকে এই ঘরের চাবি দিয়ে একটা কাজের ভার দেন। আমরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলাম কিছুক্ষণ ওখানে বসে। আশ্রমের অপেক্ষাকৃত কাছে, স্বরূপনান্দ পয়েন্টেও রয়েছে এরকম কুটির। সেখানেও একই রকম পরিবেশ। পাশেই রয়েছে আশ্রমের গো- শালা এবং কিছু চাষের খেত আর তার পরেই স্বামীজির স্মৃতি-জড়িত জলাশয়।

বিবেকানন্দ হ্রদ
প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য

এবারে দেখলাম পুরো লেকটার তলা ও চারদিকের পাড় মোটা প্ল্যাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢেকে তারপর জল ভরা হয়েছে, যার ফলে সবসময় ওখানে জল থাকে। মনে আছে, প্রথম বারে, আশ্রমাধ্যক্ষ পূজনীয় স্বামী মুমুক্ষানন্দজির অনুমতি নিয়ে আমরা কয়েকজন হাসপাতাল বাড়ির পাশ দিয়ে অনেক নীচে নেমে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি এক ঝর্ণার ধারে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের দাহস্থল দেখে এসেছিলাম। সঙ্গে আশ্রমের একজন কর্মচারি ছিলেন গাইড হিসাবে। ওই জায়গায় ভাল্লুক ও লেপার্ডের আনাগোনা থাকায় মহারাজ সাধারণতঃ কাউকে যেতে দিতে চাইতেন না।

বিবেকানন্দ পয়েন্টে সাধন কুটির
স্বরূপানন্দ পয়েন্টে সাধন কুটির

প্রথমবার যখন মায়াবতীতে থেকেছিলাম তখন সকালের জলখাবারের পরে আশ্রমপ্রাঙ্গণে একটা বড় গাছের তলায় আমরা বসতাম, আর ওপরের বারান্দায় সন্ন্যাসীরা মধুর-গম্ভীর সুরে বেদপাঠ করতেন। এবারে দেখলাম, সেই একই সময় একটা পাঠকক্ষে অতিথিরা সবাই বসেন। স্বামীজির কোন একটা লেখা পাঠ ও ব্যাখ্যা করেন একজন সন্ন্যাসী মহারাজ। আবার, রাত্রের প্রসাদের পরে আশ্রমের যে ঘরে আগে একটা ফায়ার প্লেস ছিল, সেখানে গ্রন্থপাঠ হয়। এই পাঠ শোনার জন্য আশ্রমের সন্ন্যাসীবৃন্দ এবং অতিথিরা সমবেত হন। এই দুই পাঠচক্রে যোগদান করা আশ্রমবাসী সকলের জন্য বাধ্যতামূলক।

সন্ধ্যার আগে
একঝলক হিমালয় – মায়াবতী থেকে

সব ভাল জিনিসই একসময় শেষ হয়। আমাদের আশ্রমবাসের মেয়াদও ফুরলো, এবং যথা সময়ে, আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িতে কাঠগোদাম এসে দিল্লির ট্রেণ ধরলাম। ইচ্ছে ছিল গতবারের মতো পাহাড়-জঙ্গলের পথে দেবীধুরা হয়ে কাঠগোদাম যাবো। কিন্তু সে পথে সময় বেশি লাগবে – এখন সময় মহার্ঘ, আর শুধু শুধু পাহাড়ি পথে যেতেও আমাদের চালকের অনীহা। অগত্যা আবার টনকপুরের পথেই প্রত্যাবর্তন। এই পথ সরল, পাহাড়ে গাড়ি চলছে মনেই হয় না – গাছপালা প্রায় শেষ, শুধু চলতি নদী আজও বয়ে চলেছে ক্ষীণ ধারায়।

______