শহরের সীমা ছাড়াতেই দুপাশে ঘন সবুজ ক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে কালো ফিতের মতো পীচের রাস্তা। দূরে আবছা দেখা যায় ছোট ছোট পাহাড়ের সারি। আমরা চলেছি পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডার অন্যতম বিখ্যাত মার্চিসন ফলস ন্যাশনাল পার্কে।
কাম্পালার পাশে বিশাল ভিক্টোরিয়া হ্রদের ধারে পিকনিক করে আর জিঞ্জায় নীল নদের উৎস বেড়িয়ে আরও একটু বড় সফরের জন্য উসখুস করছি, এমন সময় আলাপ হয়ে গেল ও দেশের বনবিভাগের ডিরেক্টরের সঙ্গে। আমার বেড়ানোর ইচ্ছে শুনে উনি বললেন মার্চিসন ফলসের কথা, এবং ভরসা দিলেন যে ছোট গাড়ি ও অনায়াসেই যেতে পারবে জঙ্গলের রাস্তায়। উনি আরও অনুরোধ করলেন যে যদি মার্চিসন ফলস এ যাই, যেন বনবিভাগের বান্ডা বা কুটীরে থাকি। অতএব একদিন কাকভোরে সপরিবারে বেরিয়ে পড়া গেল। সঙ্গে প্রচুর খাবার জল, কিছু খাবার দাবার, আর জেরিক্যানে অতিরিক্ত পেট্রল নিয়ে। ও পথে মাসিন্ডি ছাড়া কোথাও পেট্রোল পাওয়া যাবেনা, তাই এই ঝুঁকি টা নিতেই হল।
আমাদের যেতে হবে উত্তরমুখী কাম্পালা-গুলু সড়ক ধরে কাফু নদীর পুল পর্যন্ত। সেখান থেকে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে জেলা শহর মাসিন্ডি। তার পরে জঙ্গলের পথে মার্চিসন ফলস। প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের পথ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কল্যাণে উগান্ডার হাইওয়ে গুলো খুবই সুন্দর, যদিও বেশী চওড়া নয়। পথে গাড়ি খুবই কম। কাজেই রীতিমতো জোরেই গাড়ি ছোটানো গেল। বেশ কিছু গ্রাম দেখলাম পথে – বাচ্চারা বই নিয়ে চলেছে স্কুলে।
ঘন্টা দুই পরেই পৌঁছে গেলাম কাফু নদীর ব্রীজে। ব্রীজ পার হতেই বাঁ দিকে মাসিন্ডি যাবার লাল কাঁকড়ের রাস্তা। দু পাশে বালির ঢাল, আর তার পরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বিশাল বিশাল গোরুর র্যাঞ্চ । মাসিন্ডির গোরু আর দুধ ও দেশে প্রসিদ্ধ। জনহীন রাস্তা। র্যাঞ্চ ছাড়াও মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ে ভরা মাঠ আর বাবুল জাতীয় গাছের জঙ্গল। সব সময় মনে হচ্ছিল ঐ বুঝি বন্দুক হাতে বেরিয়ে এল লর্ডস লিবারেশন আর্মির কোন দল, বা নিদেন পক্ষে কোন লুঠেরা – ওখানে যাদের বলা হয় “thugs”! এরকম কিছুই অবশ্য ঘটেনি। প্ল্যান মাফিক ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম মাসিন্ডি। জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ দ্বার এখান থেকে ৮০ কিলোমিটার।
মাসিন্ডি হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার রাস্তায়। আর কাঁকড় নয়, পাথরকুচি ও মাটির রাস্তা। দুদিকের বসতি ধীরে ধীরে কমে গিয়ে শুরু হল পাতলা জঙ্গল, যা পরে মিশে গিয়েছে মার্চিসন ফলসের ঘন জঙ্গলে। খানিক বাদেই দেখি পুরো রাস্তা বন্ধ করে লোহার গেট। মার্চিসন ফলসে স্বাগত জানিয়ে বোর্ড ঝুলছে। পাশেই কাঁঠাল গাছের ছায়ায় কিছু পরিচ্ছন্ন মাটির ঘর – বনবিভাগের অফিস। হাস্যমুখ অফিসারের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে ও বন প্রবেশের নির্দিষ্ট দক্ষিণা দিয়ে বনে প্রবেশ। অফিসারটি আমাদের বললেন, যদিও ঐ জায়গা থেকে ন্যাশনাল পার্ক শুরু, নীলনদের এ পারে, মানে আমরা যেদিকে আছি সেদিকে কোন বড় জানোয়ার নেই। সেসে মাছি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিলেন। বেশ একটা গা ছমছম বন্য রাস্তায় গাড়ি চলল। এবার লক্ষ্য বনবিভাগের “নাইল ক্যাম্প”।
পথে গাড়ির গতি নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে ৪০ কিলোমিটারে। রাস্তা মাটির, কিন্তু বেশ ভাল। পথ যেন আর শেষ হয় না – চলেছি তো চলেছি। একটাই রাস্তা গেছে সোজা নীল নদ পর্যন্ত, কাজেই পথ হারাবার প্রশ্ন নেই। আর হারালেই বা কি, সাহায্য করার মতো জনপ্রাণী তো নেই! পথে জন্তু জানোয়ারের মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু বেবুন এবং অজস্র হরিণ। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই অবশ্য দেখা মিলল কয়েকটা জীপের, আর তার পরেই পৌঁছে গেলাম আমাদের অস্থায়ী ঠিকানায়। কাম্পালা ছেড়েছিলাম ভোর ছটায়, আর এখন বাজে ঠিক বারোটা।
দেখতে অবশ্যই বান্ডা বা কুটির, কিন্তু ভিতরের ব্যবস্থা যথেষ্ট আরামদায়ক। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বিছানা ও টয়লেট, জাল দেওয়া বড় বড় জানালা। আমাদের বান্ডায় ছিল তিনটে ঘর। এরকম পাঁচ ছটা কুটির ছড়িয়ে আছে বেশ বড় একটা পরিসরে। ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা রেস্তোরাঁ যেখানে সবরকম পানীয় ও মোটামুটি খাবারদাবার মেলে। কোন বেড়া বাঁ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নয় জায়গা টা, যদিও চার দিকে ঘন জঙ্গল। আমাদের খুব পছন্দ হয়ে গেল। কয়েকজন পর্যটক রয়েছেন দেখলাম, সঙ্গে বাচ্চারাও।
লাঞ্চ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম বনবিভাগের বুকিং অফিসে, লঞ্চ বুক করার জন্য। বেলা দুটোয় লঞ্চ ছাড়ল ১৭ কিলোমিটার দূরের মার্চিসন ফলসের দিকে। আরও দুজন বিদেশী আমাদের সঙ্গী । এঁদের সঙ্গে আলাপ জমতে দেরী হলনা। আমাদের গাইড ফ্রেড্রিকের হাতে বাইনোকুলার, আমার গলায় ক্যামেরা। লঞ্চ চলল জলপ্রপাতের দিকে, ধীর গতিতে। কারণ প্রপাতটাই শুধু নয়, আরও অনেক কিছু দেখার আছে এই পথে। হঠাৎ চোখে পড়ল একদল জলহস্তী। দেখেই ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও সবিস্ময় আনন্দ উচ্ছ্বাস। অগুন্তি হিপো দেখলাম কয়েক মিনিটের মধ্যে।
জলের মধ্যে এগিয়ে আসা একটা ব-দ্বীপের মতো জায়গায় আমাদের লঞ্চের চালক ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। গাইড বলে উঠল, “এলিফ্যান্ট”। সামনেই দেখি একটা বেশ বড় হাতির পাল – ছানাপোনা সমেত।
ক্রমে তীরের জঙ্গল দূরে সরে গেল। এখন পাথুরে পাড় – কোথাও একটু ঝোপঝাড়। গাইডের কথা মতো আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেই দিকে। দেখি কাঠের গুঁড়ির মতো চুপ করে পড়ে আছে মস্ত কুমীর। আরও দেখা হল অজস্র পাখী এবং ফিশিং ঈগল ।
\
পশু পাখী দেখতে দেখতে কখন যে জলের চেহারা বদলে গেছে, অনেক বেড়ে গেছে স্রোত আমরা খেয়াল করিনি। এখন দেখি প্রবল স্রোত ঠেলে আমাদের লঞ্চ চলেছে, জল ভরে গেছে অজস্র ফেনায়। বাঁক ঘুরতেই নজরে এল জলপ্রপাত। জলের মধ্যে জেগে ওঠা কতকগুলো বড় বড় পাথরের গায়ে লাগল আমাদের লঞ্চ। ফলস এখান থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে, কিন্তু লঞ্চ আর যাবেনা। এখানে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম কি দারুণ বেগে প্রায় ১৫০ ফুট উপর থেকে এক সংকীর্ণ গিরিখাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীল নদ।
জলপ্রপাতের ভীষণ আওয়াজ, দুপাশের নিবিড় বনানী, নীলের জলে আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের ছায়া – সব মিলিয়ে এক অপূর্ব অনুভূতি। ফিরে এসে একটু পরেই গেলাম ওপর থেকে মার্চিসন ফলস দেখতে। পাহাড়ী পথে বেশ কিছুটা উপরে উঠে একটা টিলার উপর থেকে দেখলাম জলপ্রপাতের আর এক রূপ। ফেরার পথে দেখি গাড়ি থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে এক বিশাল বাইসন। বাইসনটার কটমট করে তাকান দেখে আমরা আর দাঁড়ালাম না।
ক্যাম্পের রেস্তরাঁয় বসে চা খেতে খেতে দেখি এক পরিবার তাদের বান্ডার সামনে ছোট্ট একটা তাঁবু খাটিয়ে ফেলেছে। বাচ্চারা ওর মধ্যে রাত কাটাবে। ঐ বয়স থেকেই বাবা-মা এদের উৎসাহ দেন এই ধরণের সাহসিকতার কাজে। বড় হয়ে এরাই বেরিয়ে পড়বে সারা পৃথিবী ঘুরতে। আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর দেখছি নীল নদের জলে গা ধুতে নেমেছে বিশাল এক হাতি।
জেনারেটরের দৌলতে ক্যাম্পে মিটমিটে আলো জ্বললেও চারিদিকের ঘন জঙ্গল অন্ধকার হতেই যেন আমাদের ঘিরে ধরল। রাতের খাওয়া সেরে হাতে টর্চ নিয়ে একবার নদীর ধারে গেলাম সেই নিরেট অন্ধকারের মধ্যেই। ওরকম অন্ধকার আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। তারই মধ্যে জেটির ধারে পাহারা দিচ্ছে এক জওয়ান। তার কাছে জানা গেল একজোড়া হিপো নাকি আমাদের ক্যাম্পের দিকেই গেছে একটু আগে। শুনে ত আমরা পড়ি কি মরি করে ফিরে এলাম। রাত দশটায় আলো নিভে গেল। আকাশে মেঘ জমেছে, বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। পরের দিন ভোরে আমাদের নীলের ওপারের জঙ্গলে সফর হবে কি না ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। অপূর্ব এক ভোরে ঘুম ভাঙল ।
ফ্লাস্কে চা, খাবার আর জল নিয়ে ঠিক সাতটার সময় পৌঁছে গেলাম জেটির কাছে। আমাদের সঙ্গে যাবেন স-শস্ত্র ফরেস্ট ‘রেঞ্জার’ ডেভিড। গলায় বাইনোকুলার। যথাসময়ে গাড়ি সমেত ফেরি পার হয়ে ডেভিডের নির্দেশ মতো গাড়ি চালালাম। লক্ষ্য পাকোয়াচ এয়ারফিল্ড। আসার আগে বন অফিসের ব্ল্যাকবোর্ডে দেখেছি গতকাল কয়েকটি সিংহ ঐ অঞ্চলে ছিল। ডেভিড বলল আমরা যেন আশপাশের গাছগুলোর ডালের উপর নজর রাখি – লেপার্ডের দেখা মিলতে পারে। ও বসেছে আমার পাশেই, জানলা দিয়ে আধখানা শরীর বার করে, চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে।


আমাদের সিংহ দেখাতে না পারায় মরিয়া হয়ে ডেভিড গাড়ি ঢোকাতে বলল সাভানা ঘাসের জঙ্গলে। ঢুকে দেখি ভিতরটা এক অপূর্ব মাঠ, আর অল্প দূরেই ঘাস খাচ্ছে পালে পালে হরিণ। এখানে আমরা আমাদের প্রাতঃরাশ সারলাম। তার ফাঁকে ফাঁকে ডেভিডের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল হরিণ গুলোর চলাফেরার দিকে। ওদের মধ্যে কোন চঞ্চলতা দেখলেই বুঝতে হবে আশে পাশে পশুরাজ কিংবা লেপার্ডের থাকার সম্ভাবনা। আমাদের ভরসা ছিল এই যে এখানকার সিংহেরা মানুষ খায় এরকম কোন রিপোর্ট ছিল না।
কিন্তু না, সারা দিন ঘুরেও আমরা কোন লেপার্ড বা সিংহের লেজ ও দেখতে পাইনি ডেভিডের অনেক চেষ্টা সত্বেও। সিংহ আমরা দেখেছিলাম পরে – কুইন এলিজাবেথ ন্যাশনাল পার্কে। সে গল্প অন্য সময় বলার ইছে রইল। এ যাত্রায় আমরা দেখলাম অনেক জিরাফ, বাইসনের দল, হাতি এবং বেশ খানিকটা দূর থেকে দুটো হায়েনা। তা ছাড়া এই রকম শ্বাপদসংকুল বনের মধ্যে প্রকৃতি কে এ ভাবে কাছে পাওয়াটাই একটা বিশাল অভিজ্ঞতা।
*****
Note: All photos were taken by me