দেশে যখনই কোন মহামারী বা ওই জাতীয় কোন বিপদ আসে, তখনই একদল উচ্চশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ  আমা্র মতো অজ্ঞ মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার মহান ব্রত নিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে আবির্ভূত হন। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়ও এর ব্যত্যয় হয়নি।

যেহেতু কোভিড একটি মহামারী বা “অতিমারী”, স্বাভাবিক ভাবেই এই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ডাক্তারবাবুদের সংখ্যাই বেশী। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে এঁদের বেশীরভাগই কোনও একটা ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত নন। আর যদি “অন প্রিন্সিপল” কোনও একটা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতৈক্য হয়ও, “স্পেসিফিক্সে” এলেই প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অভিমত।

এই ধরুন মাস্ক পরা। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সব বিশেষজ্ঞই একমত। কিন্তু কি ধরণের মাস্ক পরা উচিত সে ব্যাপারে “বিপ্রা বহুধা বদন্তি” । প্রথমদিকে, যখন সমাজসেবী ব্যবসায়ীরা “বাজারে মুখোস নেই” বলে সামান্য বেশী দামে আমাদের দয়া করছিলেন, তখন শুনলাম, “সাধারণ মাস্ক কোন কাজের নয়। এন৯৫ মাস্কই একমাত্র পরিত্রাতা”। করোনা রাক্ষুসীর ভয়ে আমরা তখন হন্যে হয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছি এন৯৫-এর খোঁজে ।

পরের ব্যাচের বিশেষজ্ঞেরা নিদান দিলেন, “সাধারণ কাপড়ের মাস্ক, মেয়েদের দো-পাট্টা, এমনকি — অধুনা বিরল প্রজাতির জীব — গামছা পর্যন্ত করোনা-সংক্রামিত জলকণার আমাদের শরীরে ঢোকা রুখে দিতে সক্ষম। ব্যস। এখন রাস্তায় হরেক রকমের মুখ-ঢাকা চোখে পড়ছে। আমাদের খলিশাকোটার বাজারে শাড়ি-পরা মহিলারা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকার অভিনয় করে দিব্যি কেনাকাটা করছেন।

মুখোস নিয়ে যাহোক একটা ঐক্যমত্যে পৌছলেও আবার গোল বাধলো কখন এবং কতক্ষণ মুখোস পরতে হবে বা পরা উচিত তাই নিয়ে। এব্যাপারে প্রত্যেক টেলিভিশন চ্যানেলে যথারীতি বিশেষজ্ঞদের সমাহার হলো। কেউ বললেন খোলা জায়গায় ব্যায়াম করার বা হাঁটার সময়ে মুখ ঢাকা শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, শরীরের জন্য ক্ষতিকরও বটে। কারণ-স্বরূপ তাঁরা আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের হওয়া কার্বন ডাই  অক্সাইড মুখোসে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার শরীরে ঢোকার বিপদের কথা শোনালেন। বললেন মাস্ক পরার ফলে শরীরে অক্সিজেন প্রবেশ কমে যাওয়ার কথাও।

আবার একই ব্যাপারে অন্য়েরা বললেন যে ব্যায়াম করার বা হাঁটার সময় যদি অন্য কেউ কাছাকাছি না থাকে তাহলেন মুখোস পরা অনাবশ্যক। তাঁরা কার্বন ডাই অক্সাইডের ব্যাপারটাকে আমল দিলেননা। শেষ পর্যন্ত স্থির হলো যে “মাস্ক একটা গলায় ঝুলুক, কোন লোক কাছাকাছি এলেই সেটাকে নাকের ওপরে টেনে দেবেন” ।

নতুন যে শব্দবন্ধ আমরা করোনার দৌলতে পেলাম সেটা হচ্ছে “সামাজিক দূরত্ব”। জানিনা এটার উৎপত্তি এদেশে, না এটা আমরা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে নিয়েছি। মানুষের ,বিশেষকরে পরিচিত বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে একটা বিশেষ দূরত্ব রাখাটা কিধরণের সামাজিকতা আমি জানিনা। এটাকে যদি শারীরিক দূরত্ব রাখা বলা হত, তাহলে বোধহয় ঠিক হতো। কিন্তু এই “দূরত্ব” কতটা হবে সে নিয়েও সেই মতভেদ। প্রথমে শুনলাম দু’ মিটারের ফারাক হচ্ছে আদর্শ। মনে মনে ভেবে দেখলাম ছ’ ফুটের একটু বেশী দূরত্ব রাখলেই চলবে। আমাদের এখানে সেটাও অবশ্য অসম্ভব। যেখানে ইঞ্চি খানেক দূরত্ব রাখাই দুষ্কর, ছ’ ফুট দূরে দূরে মানুষ থাকলে তো বাড়ি থেকে বেরিয়েই লাইনে দাঁড়াতে হবে!

এদিকে অন্য একজন বিশেষজ্ঞ বলে বসলেন, অবশ্যই কোন বিদেশী পত্র-পত্রিকা বা গুগল মাস্টারের সৌজন্যে, যে কোভিড১৯-বাহী জলকণাগুলো এমনকি ১৫ফুট দূরত্বে থাকা মানুষকেও সংক্রামিত করতে পারে। দিল্লি থেকে আমার গিন্নির এক বন্ধু বললেন যে কোনও একটি চ্যানেলে তিনি শুনেছেন যে কোভিড আক্রান্ত কোন মানুষ রাস্তায় হাঁচলে বা কাশলে তাঁর মুখ-নিসৃত জলকণা-বাহিত ভাইরাস প্রায় দু’ ঘন্টা সেখানে ঘুরতে থাকে এবং অন্যদের সংক্রামিত করতে পারে। এরপরে আর রাস্তায় বেরহবে কোন মূর্খ !

যাইহোক, মুখোস দিয়ে বা অন্যকিছু দিয়ে মুখ ঢাকা গেল; বাইরে বেরনো প্রায় বন্ধ, আর বেরোলেও  মানুষজনকে আসতে দেখলেই চকিতে দূরে সরে যাচ্ছি – তাঁরাও তাই করছেন। ভাবলাম এসব করে করোনার হাত থেকে কিছুটা হলেও বাঁচা যাবে। কিন্তু না। এবার আমাদের বিশেষজ্ঞরা চোখ নিয়ে পড়লেন। এক জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ‘প্রচার’ করলেন যে চোখ কোভিডের এক অন্যতম প্রধান প্রবেশ পথ। সেটা অবশ্য সত্যি, কারণ প্রথম থেকেই বলা হচ্ছিল বাইরে থেকে ফিরে সাবান দিয়ে হাতধোয়ার পরেই যেন মুখে-চোখে হাত দেওয়া হয়। কিন্তু এবারে ইনি বললেন , “ফেস-শীল্ড ব্যবহার করুন”। ব্র্যান্ডটা বলেননি। সম্ভবতঃ “আগামীতে” বলবেন।

হাতধোয়া নিয়েও বিশেষজ্ঞদের গবেষণা-প্রসূত জ্ঞান থেকে আমরা বঞ্চিত হইনি। প্রথমে তাঁরা বললেন ‘সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোবেন’, কারণ কোভিড-১৯এর ভাইরাস সাবান ও জলের মিশ্রণের কাছে কাবু। এটাও বলা হল যে অন্ততঃ কুড়ি সেকেন্ডধরে এই হস্ত-প্রক্ষালন করলে তবেই আর বিপদ থাকবেনা। এরপর একজন আবার রীতিমতো ভিডিও রেকর্ড করে বললেন সংক্রমণ এড়াতে হলে “দু’ ঘন্টা অন্তর অন্তর হাত ধূতে হবে”।

মাথাটা গুলিয়ে গেল। বাড়িতে বসে আছি, করমর্দন তো দূরের কথা, কারোসঙ্গে দেখা-সাক্ষাত নেই, অথচ ঘড়িধরে দু’ঘন্টা হলেই , “হাত ধুয়েছ?” বলে রিমাইন্ডার! বললাম, বাইরে তো যাইনি, খামোখা সাবান দিয়ে  হাত ধূতে যাবো কেন? না, কোন এক মহিলা ডাক্তার বলেছেন। অনেক কষ্টে বোঝাই যে উনি সম্ভবতঃ তাঁদের জন্য এ কথা বলেছেন যাঁরা ডিউটিতে আছেন এমন ডাক্তার বা নার্স, আর দোকানদার বা যাঁরা অফিসে কাজ করেন। আমি ঘরে বসে বসে দু’ ঘন্টা অন্তর হাত ধুলে ডেটল কোম্পানি খুশি হতে পারে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবেনা। 

করোনাকে কয়েকদিনের জন্যে তুড়িমেরে উড়িয়ে দিয়ে আমফান ঘাড়ে এসে পড়ল। এবার টিভিতে দেখা গেল এক অন্যধরণের বিশেষজ্ঞদের। তবে এঁদের হাতে মোটামুটি আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র ছিল – স্যাটেলাইট, রাডার, ইত্যাদি, আর সেই ‘চিরকালের চেনা লোকের’ ব্যারোমিটার। শুধু একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে যুদ্ধে নামার মতো উপদেশ ছিলনা, এবং তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে আমফান প্রায় চার ঘন্টা ধরে লম্ফঝম্ফ করে বড় বড় গাছ আর গরীবের কুঁড়েঘরগুলোকে ধরাশায়ী করে চলে গেল। দেখা গেল এই আবহবিদরা প্রকৃত অর্থেই বিশেষজ্ঞ।

মজার কথা হচ্ছে, করোনা-বিশেষজ্ঞরা আমাদের যতদূর সম্ভব ভয় দেখাচ্ছিলেন, অথচ সমানে বলে চলেছিলেন, “আতঙ্কিত হবেন না”। এদিকে কেন্দ্রের সরকার তো “আমাদের আর কিছু করার নেই, সব খুলে দিলাম” বলে করোনার সঙ্গে বসবাস করার পরামর্শ দিয়েছেন, আর রাজ্যসরকার আরও একধাপ এগিয়ে করোনাকে জড়িয়ে শুতে বলেছেন। এখন দেখার, ‘করোনা বালিশ” কোথায় পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনে অর্ডার দেব ভাবছি।

সব বিশেষজ্ঞরাই যখন “বাইট” দিলেন, তখন ভূমিকম্প-বিশারদরা বাদ যাবেন কেন? বিশেষতঃ যখন উত্তরভারতে পর পর কয়েকটা ভূকম্পন হয়ে গেছে গত তিন মাসে। তাই এখন ওব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হ্যাঁ, নিজের কানে শুনেছি, ‘শীগগিরই একটা বড়সড় ভুমিকম্প হতে পারে” । আমরা জানি, আজপর্যন্ত ভূমিকম্পের পূর্বাভাষ দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়, ঘনাদার মাগুরমাছ ছাড়া। তা যদি করা যেত তাহলে বোধহয় জাপান সবচাইতে খুশি হত, এবং হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচত ।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের ভূ-বিশেষজ্ঞরা “হতে পারে। শীগগিরই হতে পারে” এইসব কথা বলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর মহান কাজটি করছেন। আর টিভি চ্যানেল-ওয়ালারা ও খবরের ব্যাপারীরা তার সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন “ঈদের আগেই হতে পারে, পূজোর আগেই হতে পারে” ইত্যাদি “হাড়-হিম করা” তধ্য। কিন্তু তাঁরা ভুল বলছেন না মোটেই। নিশ্চয় হতে পারে। এই আমার লেখার সময়ও হতে পারে। একটু পরেও হতে পারে, “পূজোর আগে তো হতে পারেই”।

এতদিনে বুঝলাম, যিনি বিশেষজ্ঞ শব্দের অর্থ করে ছিলেন “বিশেষরূপে অজ্ঞ – ইতি” তাঁর মতো ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞ সত্যিই ক্ষণজন্মা ব্যক্তি, প্রাতঃস্মরণীয়।